“দিন গেলেই ৫৫০ রুপি লজ ভাড়া গুণতে হচ্ছে। খেতেও হচ্ছে নিজের টাকায়। টাকা শেষ, খাবার যা আছে টেনেটুনে দুই দিন চলবে। বাংলাদেশ হাইকমিশনে দফায় দফায় কল করছি, কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। পরবাসে ভাগ্যে কী আছে, কিছুই বুঝছি না!”
ফোনের ওপাড় থেকে এক নিঃশ্বাসে এভাবে কথাগুলো জানালেন ভারতের বেঙ্গালুরুতে আটকেপড়া বাংলাদেশি মেহেদী হাসান আরিফ। তার বাড়ি রাজশাহী মহানগরের সপুরা এলাকায়। গত ৩ মার্চ অসুস্থ মামা ও সঙ্গে মামিকে নিয়ে বেঙ্গালুরুর নারায়ণা হাসপাতালে পৌঁছান তিনি।
তার মামার ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছে। গত ২৭ মার্চ তাদের ট্রিটমেন্ট শেষ হয়। তবে ভারতে লকডাউন চলায় সেখানে আটকে পড়েছেন তারা। উঠেছেন বোম্মসান্দ্রা শিল্প এলাকায় অবস্থিত শান্তিনিকেতন গেস্ট হাইজে। মেহেদী আরিফের তথ্যমতে, ওই লজে আটকে পড়েছেন ১৫ জন বাংলাদেশি। সেখানে অজানা শঙ্কা মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।
বার্তা২৪.কমকে মেহেদী আরিফ বলেন, ২৯ তারিখে সবশেষ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল। তারা আমাদের সকলের তথ্য নিযে জানিয়েছিল— ১৪ তারিখে ভারতে লকডাউন উঠে গেলে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এরপর আর কোন খবর নেয়নি। আমরা কল করলেও রিসিভ করছে না।
তিনি বলেন, লজের আশেপাশে কোনো বাড়ি-ঘর নেই। পুরোটা শিল্প এলাকা। লজ থেকে বের হয়ে মূল রাস্তায় গেলেই তাড়া করছে পুলিশ। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনোমতে চাল-ডাল, শাক-সবজি কিনে গত ১৭ দিন কাটছে। যে দোকান থেকে খাদ্যসামগ্রী কিনছিলাম, সোমবার (১৩ এপ্রিল) সেই দোকানিও জানালেন—আগামীতে আর চাল-ডাল নাও পাওয়া যেতে পারে।
লজে আটকে পড়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মনাকষার দুই সহোদর মিজানুর রহমান ও মামুনুর রশিদ। চিকিৎসার জন্য বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন।
মিজানুর রহমান মোবাইলে বার্তা২৪.কমকে জানান, লকডাউনের পর লজ থেকে বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার কথা ছিল। দু’দিন দিয়েছিলও। পরে তারা খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
ভেলোরে যারা আছেন, তাদের লজ ভাড়া কমানো হয়েছে। সেখান থেকে খাবার দিচ্ছে বলেও শুনলাম। কিন্তু আমরা কিছুই পাচ্ছি না। দুই-তিন দিন পর খাবারও থাকবে না। কী যে করব, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, বলেই ঢুকরে কেঁদে ফেলেন মিজানুর রহমান।
মেহেদী ও মিজানুরের তথ্যমতে, লজে আটকে পড়া অন্যরা হলেন— রাজশাহীর শিরোইল কলোনির মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী সখিনা কামাল, শিবগঞ্জের মনাকষার মামুনুর রশিদ, চট্টগ্রামের শীতাকুণ্ডের আব্দুল হোসাইন ও তার পরিবারের দুই নারী সদস্য, খুলনার রায়পাড়ার শোয়েবুর রহমান এবং তার পরিবারের একজন নারী ও আরেকজন পুরুষ সদস্য, জামালপুরের মাদারগঞ্জের নিশ্চিন্তপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী এবং ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার সুনীল সাহা এবং তার পরিবারের একজন নারী সদস্য।
শান্তিনিকেতন গেস্ট হাইজের কাছাকাছি ¬¬স্বৈতা গেস্ট হাউজে আটকে পড়েছেন আরও ৪৫ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে আতিকুল ইসলাম নামে একজন রাজশাহী নগরের বাসিন্দা।
তিনি বলেন, আমার ৭ মাস বয়সী বাচ্চার হার্টে ছিদ্র। চিকিৎসা করাতে গত ১২ মার্চ ভারতে এসেছি। নারায়ণা হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা সেবা পাইনি। তারা এখন আমাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছে।
আতিকুল আরও বলেন, গেস্ট হাউজে প্রতিদিন রুম ভাড়া ৮০০ রুপি। ভাড়ার টাকা বকেয়া হয়েছে। হাতে টাকা-পয়সা শেষ। গেস্ট হাউজের বেশ দূরে কাঁচাবাজার ও একটি মুদিখানা দোকান আছে। সেখানে খাবার কিনতে বের হলে পুলিশ বাধা দেয়।
তিনি আারও জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ৪৫ জন বাংলাদেশি স্বৈতা গেস্ট হাউজে আটকে পড়েছেন। সবাই রোগী নিয়ে এসেছিলেন। তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। হোটেল থেকে খাবারসহ কোনো সার্ভিস নেই। শুধু কোনমতে থাকার ব্যবস্থাটা হচ্ছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করছি। তারা কোনো সহযোগিতাও করছে না।
আতিকুল বলেন, এখানে আমরা প্রতারণার শিকারও হচ্ছি। এয়ার এশিয়ার লোকজন এসে বিমানের টিকিট দিয়ে গেছে। ৬৫ হাজার টাকার টিকিট নিয়েছি। কিন্তু ভারতে লকডাউন বাড়ানোয় তারা আর যোগাযোগ করছে না। বলছে— পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিমান চললে ব্যবস্থা করবে।
এদিকে, লকডাউন শেষে চেন্নাই হয়ে সিলেট ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন বেঙ্গালুরুর অন্য একটি লজে আটকে পড়া ১২ জন বাংলাদেশি। শনিবার (১১ এপ্রিল) সকালে বেঙ্গালুরু থেকে চেন্নাই ৩০০০ রুপি এবং চেন্নাই থেকে সিলেটে ১৯০০০ রুপি মূল্যে আগাম টিকিট সংগ্রহ করেন।
তবে টিকিট সংগ্রহের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানোর ঘোষণা দেন। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। এসব তথ্যও জানিয়েছেন বেঙ্গালুরুর শান্তিনিকেতন লজে আটকেপড়া মেহেদী আরিফ। তবে তাদের নাম-পরিচয় বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মোবাইলে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভারতে আটকে পড়াদের বিষয়ে হাইকমিশন অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ নেবে। কিন্তু তাদের হাইকমিশনে টেলিফোন করে নাম-তথ্য দিয়ে তালিকাভুক্ত হতে হবে। পরিস্থিতি উন্নতি হলে দ্রুত তাদের ফিরিয়ে আনব আমরা।
খাদ্য সংকটে পড়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, তারা যে সমস্ত হোটেলে থাকছেন, সেখান থেকে দুঃসময়ে খাদ্য সরবরাহ করার কথা। যদি তা না করে থাকে, সেটাও হাইকমিশনে হোটেলের নামসহ জানাতে হবে। হাইকমিশন থেকে সেইসব হোটেলের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
সার্বিক বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশি সহকারী হাইকমিশন দফতরের প্রশাসনকি কর্মকর্তা শাহীন আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রতিদিনিই প্রচুর ফোন কল আসছে। আমরা তাদের নাম-পরিচয় ও তথ্য নিচ্ছি। তালিকাভুক্ত করে রাখা হচ্ছে। ভারতে লকডাউন শেষ হলে পরিস্থিতি বিবেচনা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিকে সবাইকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হবে।
বেঙ্গালুরুতে আটকেপড়াদের যেসব নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে: +৯১৯৯৩০০৭৫০২৬ (মো. লুৎফর রহমান, সহকারী হাইকমিশনার, মুম্বাই), +৯১৯৮৩৩১৯৯৩০ (নাফিসা মনসুর, ফার্স্ট সেক্রেটারি, মুম্বাই) ও +৯১৯৬৫৩২৯৮৪ (শাহীন আলম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মুম্বাই)।