সোনালী ব্যাংককে ডোবাচ্ছে খুলনার পাট ব্যবসায়ীরা!

খুলনা, জাতীয়

ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪ডটকম | 2023-08-27 13:53:53

খুলনা: রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক খুলনার ছয়টি শাখা থেকে পাট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়া হয়েছিল এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকার অধিক খেলাপি। রাষ্ট্রের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় না করেই নতুন করে আরও এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে সাতজন চিহ্নিত খেলাপিকে ৭১ কোটি টাকা পুনরায় ঋণ দেয়ার অনুমোদন হয়েছে।

তাদের কাছে সোনালী ব্যাংকের পূর্বের ২৩১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। এভাবে অর্থ নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে সোনালী ব্যাংককে ডোবাচ্ছে খুলনার পাট ব্যবসায়ীরা।

ব্যাংকের তথ্য মতে, প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপের কারণে ২০০৮-২০১৬ সাল পর্যন্ত ১১৩ পাট ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১০৮ জন ঋণ খেলাপি। খুলনায় সোনালী ব্যাংকের ছয়টি শাখা থেকে ঋণ দেয়া হয়েছিল প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে খুলনা করপোরেট শাখা, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা ও স্যার ইকবাল রোড শাখার বিতরণকৃত ঋণের প্রায় শতভাগ খেলাপি। সিসি প্লেজ, সিসি হাইপো, পিসিসি ও ব্লক হিসাবের বিপরীতে কাঁচা পাট রফতানিতে এ ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে সিসি প্লেজ হিসাবের বিপরীতে। গুদামে মজুদ থাকা পাট জামানত রেখে প্লেজ ঋণ দেয়া হয়। ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত না পেলেও গুদামের পাট বিক্রি করে দিয়েছেন ঋণ খেলাপিরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের কারণে এসব ঋণ খেলাপিকেই নতুন করে টাকা দিতে হচ্ছে বলে দাবি করেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তিনি বলেন, ‘খুলনার পাট ব্যবসায়ীরা সোনালী ব্যাংককে ডোবাচ্ছেন। পাট খাতের সব মন্দ গ্রাহক এ ব্যাংকে ভিড়েছেন। নীতিমালার মধ্যে থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েও ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংকের টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার কারণে ঋণ খেলাপিদের নতুন করে টাকা দিতে হচ্ছে।’

সোনালী ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির খুলনা করপোরেট শাখা কাঁচা পাট রফতানিতে ৫২ ব্যবসায়ীকে ৩৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এরমধ্যে ৩৮১ কোটি ৯৩ লাখ টাকাই খেলাপি হয়েছে। এ খাতে শাখাটির বিতরণকৃত ঋণের ৯৯ দশমিক ৪৮ শতাংশই এখন খেলাপি। খুলনার দৌলতপুর করপোরেট শাখা থেকে কাঁচা পাট রফতানির নামে ৬৬৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন ১৯ পাট ব্যবসায়ী। এরমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৩৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা খাতটিতে বিতরণকৃত ঋণের ৬৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ব্যাংকটির খুলনার দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা থেকে ২০ জন গ্রাহক ঋণ নিয়েছেন ৩২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে ৩১৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা ৯৮ দশমিক ৮৮ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। ব্যাংকটির খালিশপুর শাখা থেকে ১৩ পাট ব্যবসায়ীকে দেয়া ৮০ কোটি ৫৭ লাখ টাকার মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৫৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ শাখা থেকে খাতটিতে বিতরণকৃত ঋণের ৬৯ দশমিক ৯১ শতাংশই খেলাপি। এছাড়া ব্যাংকটির খুলনার স্যার ইকবাল রোড শাখা থেকে দুজন পাট রফতানিকারককে দেয়া ৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকার পুরোটাই খেলাপি হয়ে গেছে।

খুলনা অঞ্চলে সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ৩০ ঋণ খেলাপির কাছে ঋণ রয়েছে এক হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে মো. এমদাদুল হোসেনের সোনালী জুট মিলস লিমিটেডের কাছে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২৭ কোটি, অশোক কুমার দাশের এ কে জুট ট্রেডিংয়ের কাছে ১১৭ কোটি, সেলিম রেজার মেসার্স রেজা জুট ট্রেডিংয়ের কাছে ৩৮ কোটি ও সনজিত কুমার দাশের ইস্টার্ন ট্রেডার্সের কাছে ৯২ কোটি টাকা।

এর বাইরে মেসার্স শরীফ জুট ট্রেডিংয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৩ কোটি, জাহিদুল ইসলামের মেসার্স জুয়েল জুট লিমিটেডের ৪৯ কোটি, মেসার্স সিরাজুল ইসলামের ৪০ কোটি, আলীফ জুট ট্রেডিংয়ের ৩৬ কোটি, অনিক জুট ইন্টারন্যাশনালের ৩০ কোটি, সানরাইজ ইন্টারন্যাশনালের ৩০ কোটি, অগ্রণী পাট সংস্থার ২৮ কোটি, মেসার্স শরীফ মোল্যার ২৫ কোটি, মেসার্স আবুল কাশেমের ২২ কোটি, এসআর জুট ট্রেডিংয়ের ২৩ কোটি, রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়ার প্রমি জুট ট্রেডার্সের ২০ কোটি, মনোয়ারা জুট ফাইবার্সের ১৮ কোটি এবং এসঅ্যান্ডএস জুট ট্রেডিং কোং লিমিটেডের ১৮ কোটি টাকা।

এছাড়া মেসার্স হাফিজ অ্যান্ড ব্রাদার্সের কাছে ১৭ কোটি, রাষ্ট্রায়ত্ত আলীম জুট মিলস লিমিটেডের ১৬ কোটি, রোজেমকো লিমিটেডের ১৫ কোটি, ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনালের ১৫ কোটি, দ্য পাঠান জুট ট্রেডিংয়ের ১৫ কোটি, আলমগীর জুট ট্রেডিংয়ের ১৪ কোটি, আবির জুট ট্রেডিংয়ের ১৩ কোটি, আজাদ ব্রাদার্সের ১৩ কোটি ও এমআর জুট ট্রেডিংয়ের কাছে ১২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে সোনালী ব্যাংকের।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রভাবশালী মহলের তদবিরে সম্প্রতি ২৩১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের ওপর তৃতীয় দফায় ব্লক সুবিধা পেয়েছেন খুলনার সাত পাট ব্যবসায়ী। খেলাপি ঋণ ব্লক করে মো. সিরাজুল ইসলাম, এসআর জুট ট্রেডিং, বেঙ্গল জুট ট্রেডিং, নক্ষত্র জুট ট্রেডিং ও পিআর জুট ট্রেডিংকে নতুন করে ৭১ কোটি টাকা বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক খুলনা জিএম কার্যালয়ের অধীনে ছয়টি জেলার ১২৩টি শাখা। এ শাখাগুলো থেকে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে চার হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণের ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ। খুলনা জিএম কার্যালয়ের অধীনে খেলাপি ঋণ রয়েছে এক হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাভাবিক পন্থায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে ৩০১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে সোনালী ব্যাংকের খুলনা অঞ্চলের ১২৩টি শাখার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৯০ শতাংশই পাট ব্যবসায়ীদের দেয়া হয়েছে ছয়টি শাখায়। সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি শাখার মধ্যে চারটিই খুলনার। এরমধ্যে খুলনার করপোরেট শাখায় ৮১২ কোটি, দৌলতপুর করপোরেট শাখায় ৪৭১ কোটি, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখায় ৩৪৩ কোটি ও খালিশপুর শাখায় ৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফুলতলা মহিলা কলেজের প্রভাষক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থ ঋণ দেয়া ও তা সময় মতো আদায় করার আন্তরিকতার অভাবেই খেলাপি ঋণের পাহাড় সৃষ্টি হচ্ছে। পাট ব্যবসা নিঃসন্দেহে লাভজনক। তাহলে কেন বছরের পর বছর পাট ব্যবসায়ীরা ঋণ খেলাপি? তাহলে কী ব্যবসার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্য রয়েছে তাদের?’

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রায় ১২৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোনালী জুট মিলের মালিক এসএম এমদাদুল হোসেন বুলবুল ও সোনালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার নেপাল চন্দ্র সাহা, ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার কাজী হাবিবুর রহমান, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার শেখ তৈয়াবুর রহমান ও সাবেক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সমীর কুমার দেবনাথের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন দুদক সমন্বিত খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন। একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রায় ৯৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দৌলতপুরের পাট ব্যবসায়ী সনজিত কুমার দাস ও সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর শাখার দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৫ সালে প্রায় সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দৌলতপুরের মেসার্স আকবর আলী অ্যান্ড সন্সের মালিক মো. আকবর আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল।

এভাবে একদিকে খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, অন্যদিকে দায়মুক্তি দিয়ে তাদের পুনরায় ঋণ দেয়া হচ্ছে। এ সম্পর্কে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি খুলনা জেলার সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান জানান, কতিপয় অসৎ ব্যবসায়ীই বর্তমানে পাট খাতে ঋণ নিয়ে বিলাসিতার পাশাপাশি ঋণের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করছেন। সে টাকা সুদাসলে ঠিক মতো ব্যাংকে ফেরত যায় না। এ খাতের দুর্নীতি এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। ব্যবসায়ী, গোডাউন কিপার ও ব্যাংক কর্মকর্তারা যোগসাজশে টাকা আত্মসাৎ করছেন। শুধু পাট শিল্প নয় এভাবে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকলে ব্যাংকখাতেও বিপর্যয় নেমে আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর