কৃষক ভুগছে পণ্যের ন্যায্যমূল্যের অভাবে, শহুরে ক্রেতা বাড়তি দামে!

, জাতীয়

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-29 15:13:58

নাটোরের চৌরি গ্রামের চাষি আলাউদ্দীন। কৃষিই তার পরিবারের উপার্জনের মাধ্যম। বছরের বিভিন্ন সময়ে মৌসুমি সবজি চাষ করে সুখের সংসার তার! গ্রীষ্মের সিজনেও পটল, বেগুন, করলা ও ঢ্যাঁড়স চাষ করেছেন। গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার ১৫ কাঠা জমিতে শুধুই ঢ্যাঁড়স চাষ করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এবার ফলনও বাম্পার! সবুজ সবজি ক্ষেতে দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলেন আলাউদ্দীন।

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবজির বাম্পার ফলনই তার কাল হয়েছে! পাচ্ছেন না পাইকার ও ব্যাপারী— ফলে দাম তো দূরের কথা, ক্ষেতেই পচছে তার সবজি। বেগুন, পটল কেজিতে দাম পাচ্ছেন ৫ থেকে ১০ টাকা। এসব পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচেই টাকা শেষ!  

পাইকাররা না আসায় নষ্ট হচ্ছে টমেটো, বিপাকে কৃষক

সোহেল রানা, রাজধানীর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত একমাস ধরে ঘরেই বসে আছেন। মার্চ মাসের বেতন এখনো হয়নি, বরং কোম্পানি থেকে বলেছে— অর্ডার নেই, বেতন অর্ধেক পাবেন। টানাটানির সংসারে যা জমানো আছে দিয়ে চলছে সংসার। করোনার প্রভাবে বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারমূল্যের সঙ্গে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মৌসুমি সবজি করলা, ঢ্যাঁড়স ও পটল কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ টাকা দরে।

৫-১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সবজি, উৎপাদন ও পরিবহন খরচেই টাকা শেষ
কৃষকরা দাম না পেলেও শহরে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে এ সব সবজি

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সরকারঘোষিত ছুটিতে সারাদেশ অবরুদ্ধ। যদিও জরুরি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। এরপরও স্বাভাবিক পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় বন্ধ বলা চলে। এতে পচনশীল সবজি কৃষকের ক্ষেতেই পচছে। পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। অন্যদিকে কৃষক পণ্যের দাম না পেলেও বাড়তি দামে কাঁচা সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরের বাসিন্দাদের।  

কৃষকরা জানান, ক্ষেতের সবজি পরিপক্ব হয়েছে। বিক্রি করার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। বেগুন, করলা পেকে খেতে পচছে, পাইকারও পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যেসব ব্যাপারী সবজি কিনতেন তারা কেউ আসছেন না। এজন্য কৃষক নিজেই সবজি নিয়ে স্থানীয় বাজারে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে দাম পাচ্ছেন না। এতে পরিবহন ও উৎপাদন খরচই উঠছে না। সবকিছু মিলে উৎপাদিত সবজি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষক।

কাঁচাবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক না থাকায় এই মুহূর্তে কাঁচা সবজির ব্যবসা করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এগুলো পচনশীল দ্রব্য। পণ্য পরিবহন সরকারি ছুটির বাইরে থাকলেও গ্রাম থেকে সবজি নিয়ে শহরের যেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

বেগুন, করলা পেকে খেতে পচছে, পাইকারও পাওয়া যাচ্ছে না
সবজি পেকে খেতে পচছে, পাইকারও পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রির চেষ্টাতেও মিলছে না ন্যায্যমূল্য

গুরুদাসপুরের চাককৈর এলাকার ব্যবসায়ী আলী আক্কাস বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি টমেটোর ব্যবসা করি। স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রির জন্য এখন অল্প টমেটো কিনি। এই মুহূর্তে রাজধানীতে পাঠানোর মতো বড় ঝুঁকি নিচ্ছি না। পণ্য পাঠানোর সময় রাজধানীর প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশির শিকার হতে হয়। লকডাউনের শুরুতে পণ্য পাঠাতে বেগ পেতে হয়েছে। এতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হয়েছেন। এখন কৃষিপণ্য পরিবহনে সরকারি সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। এছাড়া পণ্য পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে, এতে লাভের সম্ভাবনা নেই। এজন্য কেউই কাঁচা সবজির ব্যবসা করে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।

এদিকে করোনার এ সময়টাতে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় পচনশীল দ্রব্য নিয়ে ব্যবসা করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরাও।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বার্তা২৪.কমকে বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে যারা কাজ করতেন যেমন: পাইকার, ব্যাপারী— তারা এই মুহূর্তে কৃষকদের কাজ থেকে পণ্য কিনছেন না। এজন্য সরবরাহ চেইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেশে বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য নিতে পুলিশের জেরার মুখে পড়ছেন, চাঁদা নেওয়া, পণ্য আটকে রাখাসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সে জন্য মধ্যসত্ত্বভোগীরা এখন পচনশীল পণ্য নিয়ে ব্যবসা করাটা ঝুঁকি মনে করছেন। এর ফলে সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে শহরের মানুষকে বাড়তি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে।

ক্ষেত থেকে তুলে এনে সবজি বিক্রি করতে পারছেন না ক্রেতারা
ক্ষেত থেকে তুলে এনে সবজি বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা, দাম না পাওয়া ঘরেই নষ্ট হচ্ছে এসব সবজি

এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে পণ্য পরিবহন ঠিক রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।

মধ্যস্বত্বভোগীদের ব্যবসা সক্রিয় করতে পণ্য পরিবহনে যেন বাধা না পান— তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারঘোষিত প্রণোদনার আওতায় তাদের ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া কৃষকের পণ্য সরকার কিনবেন— এ ধরনের মেকানিজম আসলে কাজে দিবে না বলে জানান সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক।

দেশের এই সংকটের সময়ে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেওয়া ও ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বাজারব্যবস্থা ঠিক রাখতে হলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

বাম্পার ফলন হলেও বিক্রি নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা
কুড়িগ্রামে এক কৃষকের খ্যাতে পটলের বাম্পার ফলন

তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, করোনার প্রভাবে পণ্য সরবরাহের সমস্যা থাকায় একদিকে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে এই সংকটের সময়ও বাড়তি দাম দিয়ে ক্রেতাকে পণ্য কিনতে হচ্ছে— এটা মেনে নেওয়া যায় না। এজন্য সরকারকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরো তত্ত্বাবধানে পণ্যের ট্রাক সরবরাহের ব্যবস্থা করা উচিত।

আরও পড়ুন:দাম নেই, হতাশ বগুড়ার সবজি চাষিরা

পাইকাররা না আসায় নষ্ট হচ্ছে টমেটো, বিপাকে কৃষক

দাম নেই, বেগুন পচছে চাষির ঘরে

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর