শিল্প ও বন্দরনগরী খুলনার ১৩৮তম জন্মদিন

, জাতীয়

মানজারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 13:37:39

শিল্প ও বন্দরনগরী খুলনার ১৩৮তম জন্মদিন শনিবার (২৫ এপ্রিল)। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের পর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে খুলনার অবস্থান। নদ-নদী বিধৌত হযরত খানজাহান আলীর (রহ.) স্মৃতি বিজড়িত শহর, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা অপরূপ এ জেলাটি লম্বা আকৃতির ও চৌকা ধরনের। দেশের প্রাচীনতম নদী বন্দরগুলোর মধ্যে খুলনা অন্যতম।

খুলনার ইতিহাস: ১৮৪২ সালে ভৈরব-রূপসা বিধৌত পুণ্যভূমি নয়াবাদ থানা ও কিসমত খুলনাকে কেন্দ্র করে নতুন জেলার সদর দফতর স্থাপিত হয় খুলনায়। খুলনা মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রিটিশদের প্রশাসনিক এলাকা বৃদ্ধি এবং ভৌগলিক অবস্থার কারণে খুলনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে ৪ হাজার ৬৩০ বর্গমাইল এলাকা, ৪৩ হাজার ৫০০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাকে নিয়ে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী খুলনার ১৩৮তম শুভ জন্মদিন আজ। এর আগে খুলনা ছিল যশোর জেলার মহকুমা। ব্রিটিশ শাসক ডাব্লিউ এম ক্লে জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

রূপসা নদী

খুলনার নামকরণ: কোনো স্থানের ইতিহাস ঐতিহ্য-অনুধাবনের ক্ষেত্রে নামকরণের তাৎপর্য নির্ণয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুলনাও তার ব্যতিক্রম নয়।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. সুকুমার সেনের মতে খুলনা এসেছে ‘খুল্লনা’ শব্দ থেকে যার অর্থ ক্ষুদ্র নৌকা ভাসে এমন স্থান। এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মতে অনেক কিংবদন্তির কথাও প্রচলিত আছে।

সুন্দরবন

কেউ কেউ বলেন, খুলনা নামের উৎস খুল্লনেশ্বরী দেবী, যিনি ধনপতি সওদাগরের স্ত্রী খুল্লনার স্মৃতিরক্ষার্থে ভৈরব নদ তীরের এক মন্দিরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, মুসলিম আমলের প্রথমদিকে আরব বণিকেরা এখানে প্রবেশ করে বলতো ‘আদ খোলনা’। এই ‘আদ খোলনা’ শব্দ থেকে খুলনা শব্দের উৎপত্তি।

খানজাহান আলী সেতু

এছাড়া বিপদাশঙ্কা টের পেলে বনের দেবী বনবিবি বাওয়ালিদের বনে যেতে নিষেধ করে বলতেন ‘নৌকা খুলোনা’। এ ‘খুলোনা’ থেকেই খুলনা শব্দটা এসেছে। এসব কিংবদন্তির সত্যাসত্য আজ আর যাচাই করার উপায় নেই।

খুলনা শব্দের উৎপত্তির বিষয়ে আরও একটা সূত্র পাওয়া যায় ১৭৬৬ সালে পশুর নদীর দক্ষিণভাগে নিমজ্জিত ‘ফল মাউথ’ নামক জাহাজের নাবিকদের রেকর্ডপত্র থেকে, যেখানে খুলনাকে ‘কুলনিয়া’ বা ‘কলনিয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রয়্যাল চত্বর

খুলনার আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ ড. শেখ গাউস মিয়ার মতে, বর্তমানে খুলনা একটা জনবহুল জেলা হলেও এক সময় তা ছিল সুন্দরবনের অংশ। বন কেটে আবাদ করা হয়েছে এ অঞ্চলে। যে কারণে বন জঙ্গল সরে গেছে। নতুন আবাদ বলেই খুলনার আর এক নাম নয়াবাদ। এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সুদূর অতীতে প্রসারিত। সমুদ্রগর্ভ থেকে অপেক্ষাকৃত পরে উত্থিত হলেও উপমহাদেশের অনেক স্থানের মতো এখানেও প্রাচীনকালে জনবসতি স্থাপিত হয়েছিল বলে জানা যায়।

মংলা বন্দর

ইতিহাস: পাল আমলে পূর্ববঙ্গে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো খুলনার জনসমাজও বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেন আমলে তাদের প্রতিনিধি এ অঞ্চল তথা বুড়নদ্বীপ শাসন করতো।

মুসলিম আমলে আসেন হযরত উলুঘ খান, এ আজম খানজাহান তথা খানজাহান আলী (রহ.)। এ অঞ্চল আবাদ ও ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যার কৃতিত্ব সুবিদিত। এরপর নানা রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে শাসনক্ষমতা চলে যায় বিদেশিদের হাতে। তাদের দ্বারাই সারা দেশের মতো এখানেও আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। খুলনা জেলার কেন্দ্রবিন্দু খুলনা। এখন যেখানে মূল শহর এক সময় সে স্থান ছিল ক্ষুদ্র একটি নৌ-বন্দর মাত্র।

খুলনার শিল্পাঞ্চল

পূর্ববঙ্গ ও আসাম থেকে কলকাতার মধ্যে যাতায়াতের একটা সহজ পথ ছিল খুলনা। ১৮০১ সালে মি. চার্লস নামে শ্বেতাঙ্গ নীলকর কর্তৃক এখানে একটা নীলকুঠি স্থাপিত হয়। তিনি তার কুঠির পাশে একটা বাজার বসান যা বর্তমানে ‘বড়বাজার’ নামে পরিচিত। ১৭৮১ সালে তা একটা থানায় রূপান্তরিত করা হয় ছিল নয়াবাদ থানা। এ নয়াবাদ অবস্থিত ছিল রূপসা নদীর ওপার। ১৭৮৬ সালে টিলম্যান হেঙ্কেলের সুপারিশ অনুসারে যশোরকে একটা জেলায় রূপান্তরিত করা হয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম জেলা। তখন খুলনা ছিল এ জেলার অন্যতম থানা। ১৮৪২ সালে খুলনা মহকুমায় রূপ লাভ করে। বলা হয় শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারী জমিদার রেণীকে ইংরেজ শাসনাধীনে আনাই ছিল এ মহকুমা স্থাপনের উদ্দেশ্য।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

উল্লেখ্য, প্রতিবছর জমকালো আয়োজনে খুলনার জন্মদিন পালিত হলেও এবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে খুলনার ১৩৮তম জন্মদিনে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি স্থানীয় উন্নয়নকর্মীরা। তবে জন্মলগ্ন থেকেই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তথা খুলনা উন্নয়নের দিক থেকে অনেক অনেক গুণ পিছিয়ে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খুলনার উন্নয়ন কর্মীরা। সম্প্রতি খুলনায় গ্যাস সরবরাহ করার জন্য যে পাইপ লাইন বসানো হয়েছিল, সে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও খুলনায় বিমান বন্দর দ্রুত বাস্তবায়ন, খুলনা মেডিকেল কলেজকে ১০০০ বেডে উন্নীতকরণ, শহর রক্ষা বাঁধসহ রূপসা ও ভৈরব নদীর তীর ঘেঁষে রিভারভিউ রোড ও পার্ক নির্মাণ, খুলনায় স্টেডিয়ামগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মেরিন একাডেমী, ক্যাডেট কলেজ, দ্রুত খুলনা টেক্সটাইল পল্লী বাস্তবায়ন, মংলা সমুদ্রবন্দর ও ভোমরা স্থল বন্দরের আধুনিকায়ন, ভৈরব নদীতে আধুনিক ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ এবং ভৈরব নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণ, আধুনিক পাবলিক হল নির্মাণ, খুলনায় শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন, সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের প্রসারসহ খুলনার ১৩৮ তম জন্মদিনে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন খুলনার উন্নয়ন কর্মীরা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর