মুখ থুবড়ে পড়েছে নির্মাণ খাত, দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা

, জাতীয়

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-25 17:27:29

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা রাখে আবাসন শিল্প বা নির্মাণ খাত। এই শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রায় ২০০টি খাত। বর্তমান করোনা দুর্যোগে অন্যান্য সেক্টরের মতো স্থবির হয়ে পড়েছে আবাসন শিল্প। প্রায় এক মাসের অধিক লকডাউনের কবলে পুরো আবাসন খাতে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। শিল্প কারখানা বন্ধ থাকায় নির্মাণ কাজ নেই। এমতাবস্থায় সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে আবাসন খাত।

বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। সরকার আর্থিক সহযোগিতা করলেই কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে আবাসন খাত? যদি এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হতে থাকে তাহলে সামনে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রিহ্যাবের তথ্যমতে প্রতিবছর ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার ফ্ল্যাট সরবরাহ করা হয়। যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই প্রবাসে বসবাসকারী ক্রেতাগণ নিয়ে থাকেন। ফলে বাংলাদেশের গৃহায়ণ শিল্প প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

আবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত মিলে প্রায় ৩৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান। করোনাভাইরাসের কারণে দেশের আবাসন শিল্পে সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্মাণ কাজ স্থবির। ফলে ৩৫ লাখ শ্রমিক কর্মহীন। সকল ডেভেলপার অফিস বন্ধ।

রিহ্যাবের সদস্য এক হাজার ১ জন। এছাড়া অনেক আবাসন কোম্পানি রয়েছে। এদের সবার কাজই বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে যারা ভবন নির্মাণ করছিলেন তাদের কাজও ঝুলে গেছে। তাছাড়া আগে যারা ফ্ল্যাট ক্রয়ের চিন্তা ভাবনা করেছিলেন বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তারাও মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

আবাসন খাত বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে কাজ বন্ধ তার ওপর আবার যদি রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়ে যায় তাহলে তো আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে এই খাতের।

এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১১ সালে আবাসন খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোনো মতে টিকে ছিল এই খাত। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো ও লোন সুবিধা দেওয়া এবং সরকারি কর্মকর্তাদের গৃহঋণ সুবিধা দেওয়ায় আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছিল আবাসন খাত। আলো দেখার আগেই অন্ধকারে আবাসন খাত। বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে এই সংকট কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল এমনটাই দাবি করছেন আবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা।

করোনাভাইরাসের অচল অবস্থার কারণে এই খাতে প্রায় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। অনেকের ফ্ল্যাট নির্মাণ শেষ হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে বুঝিয়ে দিতে পারছেন না। আবার করোনা শেষ হলে শ্রমিক বা অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পেলে এই খাতে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক ছোট–খাটো আবাসন ব্যবসায়ী এরই মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পথে বলেও জানা গেছে।

এবিষয়ে হক বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইমদাদুল হক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আবাসন শিল্প দীর্ঘদিন ধরেই ধুকে ধুকে চলছিল। বর্তমান সরকার গত বছর সরকারি চাকরিজীবীদের গৃহঋণ ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোসহ কতিপয় সুবিধা দেওয়ায় একটু ঘুরে দাঁড়াতে বসেছিল। এরমধ্যে করোনা সংকট। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাবে।

তিনি বলেন, আমার হক বিল্ডার্সেরই ১১টি প্রজেক্ট চলমান ছিল। অন্তত ৩টি বিল্ডিং এর ফ্ল্যাট আসছে জুন মাসে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। এখন তো কাজ পিছিয়ে যাবে। তাছাড়া লকডাউন উঠে গেলেও শ্রমিক পাওয়া এবং অন্যান্য উপকরণ পাওয়া সবকিছু মিলে খরচ বেড়ে যাবে। এখন যাদের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছি তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই ক্ষতি আসলে পুষিয়ে নেওয়ার মতো না। তারপরেও সরকারের কাছে আমরা সহযোগিতা চেয়েছি। অন্তত শ্রমিকদের টিকিয়ে রাখতে।

হক বিল্ডার্সের ১১টি প্রজেক্টেই কাজ করে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ শতাধিক শ্রমিক। এরা সবাই এখন বেকার। আয় বন্ধ হলেও বকেয়া বেতন দিতে হয়েছে শ্রমিকদের। আগামীতে কিভাবে টিকে থাকবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এবিষয়ে রিহ্যাবের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন, নির্মাণ শিল্প বা আবাসন খাত দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এই খাতে ধস হলে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর আগে ২০১১ সালে একবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ধস নেমেছিল। সেটা কাটিয়ে উঠতে ৩-৪ বছর লেগে যায়। এটা সহজেই কাটিয়ে উঠা যায় না। যেহেতু আবাসন খাতের সাথে জড়িত প্রায় ২০০ শতাধিক শিল্প। তাই এই খাতে ধস মানে পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া।

আবাসন খাত টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে রিহ্যাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রীর কাছে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবাসন খাতের সংকট মোকাবিলায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আবাসন খাতের সংকট মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও একটি চিঠি দিয়েছে রিহ্যাব।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে আবাসন ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান ঋণের সুদ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ ও সহজ শর্তে পুনঃতফসিল করার অনুরোধ করা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর