পুলিশ: করোনার প্রতিরোধে যারা লড়ছেন সর্বক্ষণ

, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ , ড. মো. কামাল উদ্দিন | 2023-08-30 21:37:12

ব্যস্ত, বাণিজ্যিক শহরের চট্টগ্রামের এমন ছবি একেবারেই অচেনা, অজানা। মনে হবে সুনশান-নিস্তব্ধতা ভর করছে পুরো মহানগরের সর্বত্র। যে নাসিরাবাদ-ষোলশহর স্বাভাবিক সময়ে যানজট ও ভিড়ের জন্য কুখ্যাত, সেখানে খা খা শূন্যতা।

জিইসি মোড় চট্টগ্রামের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পথের সংযোগ। সেখানেও দমবন্ধ ভিড় ও জট নেই। সবাই চলছে সতর্কতার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে। কেমন করে পরিস্থিতির উন্নতি হলো, জানতে চাই সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সার্জেন্ট সাইফুল ইসলামের কাছে।

বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, 'করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে পরিস্থিতি এমন ছিলনা। সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের পরোয়া করেনি সাধারণ মানুষ। দিনে দিনে পরিস্থিতি বদলেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দিনরাত শহরের প্রধান সড়ক থেকে পাড়া-মহল্লা, বস্তি পর্যন্ত টহল দিচ্ছেন৷ মাইকিং করছেন।  অহেতুক ভিড়, ঘোরাঘুরি, আড্ডা বন্ধ করতে পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্য কঠোর ভূমিকা পালন করছেন।'       

সারা দিন তো বটেই, বিকেল, সন্ধ্যা, রাতে চট্টগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মাইকিং করে টহল দিতে দেখা যায়। সবাইকে সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধ পালন করে ঘরে থাকার জন্য প্রণোদিত করা হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে।

সন্দেহ নেই,  বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলার লড়াইয়ে সামনের সারিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন যারা, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী তাদের অন্যতম। ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ পুলিশে উজ্জল ভূমিকা রয়েছে। চলমান করোনার আক্রমণ ঠেকাতে চিকিৎসক, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি বীরের মতো মাঠে-ময়দানে সর্বক্ষণ লড়ছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।

করোনার বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে রোববার (৩ মে) পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ৫ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য মারা গেছেন, মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫৪ জন, কোয়ারেন্টাইনে আছেন এক হাজার ৫০ জন এবং আইসোলেশনে আছেন ৩১৫ জন।

করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পুলিশের গণমুখী ও জনকল্যাণমূলক ইমেজ আরো স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। একটি সরকারি সংস্থা হিসেবে আবারো ত্যাগ, পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠায় পুলিশ বিভাগের উজ্জ্বল অবস্থান দেখা গেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে জানি, তাঁরা মানুষ হিসেবে যেরকম ভালো,  সততা ও নিষ্ঠার সাথে মানুষকে সেবা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাদের কাজ দেখে পুলিশ সম্পর্কে ধারণা উজ্জ্বল হয়।

বিশেষত, সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার পাশাপাশি দুর্যোগকালীন মুহূর্তে বাংলাদেশ পুলিশ প্রায় সব সময় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হয়নি কখনোই। পুলিশ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে, সে সামর্থ্য পুলিশের আছে, যা দেশে-বিদেশে প্রমাণিত।

বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কাজ করে দেশের জন্য প্রভূত সুনাম কুড়িয়েছেন। শান্তি মিশনে পৃথিবীর উন্নত দেশের অনেক পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ থাকলেও বাংলাদেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ নেই। বিশ্ব শান্তির জন্য তারা স্থাপন করেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

ফলে সবার মধ্যেই আশার সঞ্চার হয়েছে যে, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে শান্তিরক্ষায় যেমন সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ ভূমিকা রাখতে পারছেন,  করোনা কালীন দুর্যোগেও তারা সে দক্ষতা ও সক্ষমতা দেখাচ্ছেন। বস্তুত, কাজের মাধ্যমেই পুলিশ বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জন করতে সফল হয়েছেন।

লক্ষ্য করে দেখা গেছে, করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে চরম মাত্রায় অমানবিকতার দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে। যেমন অসুস্থ মাকে রাস্তায় ফেলে দেয়া,  সামাজিকভাবে কোরোনা রুগী ও তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের লাঠিসোটা দিয়ে আক্রমণ করা। শুধু করোনায় সামাজিক সচেতনা বজায় রাখার ক্ষেত্রেই নয়, বহুবিধ মানবিক প্রয়োজনে বাংলাদেশ পুলিশের সাহসী সদস্যরা এগিয়ে এসেছেন। রাস্তায় সামাজিক দূরত্ব, নিজের উদ্যোগে ত্রাণ দেয়া, চিকিৎসা সেবা পেতে সহযোগিতা করা, এসকল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ফলে পুলিশ সদস্যের অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবুও মনোবল হারায়নি তারা। এখনো নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। শেষ পর্যন্ত কাজ করে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার উচ্চ আদর্শ সমুন্নত রাখছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।

করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা নিবিড় হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পুলিশের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, তা যেকোনো মূল্যে অটুট রাখতে হবে। পুলিশকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে কলুষিত করার অপচেষ্টাও বন্ধ করতে হবে।  

পুলিশের কার্যক্রমকে সবধরনের রাজনৈতিক টাউট ও দালাল মুক্ত করতে হবে। পুলিশের সাথে সরাসরি জনগণের সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে হবে। জনগণের সাথে পুলিশের আচরণের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ধারা তৈরি করতে হবে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তারা আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হন। রাজনৈতিক টাউট, অর্থনৈতিক এলিট ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষমতার দাপটে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে অসহায় হয়ে পড়ে। এ সমস্যার আশু সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশের বর্তমান ইমেজ ধরে রাখার জন্য সমাজের সকল ধরনের ভালো কার্যক্রমে সব সময় তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি  করতে হবে। 

বাংলাদেশের পুলিশ সাধারণত গতানুগতিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে, বর্তমান যুগে নিরাপত্তা সংজ্ঞাটি পরিবর্তন হওয়ায়  অগতানুগতিক নিরাপত্তা, যেমন দারিদ্র বিমোচন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণ, দুঃস্থদের জন্য কাজ করা, পথ শিশুদের জন্য কাজ করা, বস্তিবাসীদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখা ইত্যাদি অগতানুগতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুলিশকে বেশি পরিমাণ কাজ করতে হবে। এ কাজগুলোর মাধ্যমে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে। পুলিশ সমাজের বঞ্চিত মানুষের আস্থার ও বিশ্বাসের প্রতীকে উত্তীর্ণ হবে।

একই সঙ্গে, পুলিশের কাজের জবাবদিহিতা যেরকম নিশ্চিত করতে হবে, তেমনিভাবে পুলিশের উপর অতিরিক্ত চাপও কমাতে হবে।  তাদের ওপর একসাথে নানা কাজের চাপ থাকলে তারা পুলিশিং কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনা। তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশের সাথেও মানবিক আচরণ করতে হবে তাহলে পুলিশও নাগরিকদের প্রতি মানবিক আচরণ করবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নমুখী অভিযাত্রাকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ত্বরান্বিত করতে পারবে।   

অবিভক্ত ব্রিটিশ-বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে যে পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠেছে, তার সুনাম ছিল সমগ্র বিশ্বে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বেঙ্গল পুলিশ। পরবর্তীতে দেশভাগ, রাজনৈতিক পালাবদল, সুশাসনের অবক্ষয়ের ফলে পুলিশ বাহিনীকেও নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। তদুপরি, বার বার যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে এ বাহিনী জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে।

একবার কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের চরম অবক্ষয়ের মুখে সৌমেন মিত্রের নেতৃত্ব সেখানকার পুলিশ হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করে। সেন্ট জেভিয়ার্স, প্রেসিডেন্সি, দিল্লির জহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে অধ্যয়নকারী সৌমেন মিত্র এমফিল গবেষণা ছাড়াও হেরিটেজ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ক্রিকেট, দাবা, গোয়েন্দা ক্ষেত্রে জড়িত ছিলেন, যার ইতিবাচক প্রভাব পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন ও গতিশীল করার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশ পুলিশের নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়েও উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এমন অনেকে সুযোগ্য অফিসার আছেন, যাদের পেশাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বহুমাত্রিক দক্ষতা সুবিদিত। বিশেষ করে, পুলিশের বর্তমান প্রধান বেনজীর আহমেদ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে র‌্যাবের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এবং দেশে-বিদেশে পেশাগত কৃতিত্ব ও সাফল্যের অধিকারী। ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী বর্তমান চৌকস নেতৃত্বে জনবান্ধব ইমেজে শুধু করোনাকালীন সময়েই নয়, দেশ ও জাতির সকল প্রয়োজনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করবে বলে সকলেই আশাবাদী।


ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম ও প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ড. মো. কামাল উদ্দিন, প্রফেসর,  আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর