আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে অনিয়ম, তবে ইউএনও’র চ্যালেঞ্জ

জেলা, জাতীয়

কান্ট্রি ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 03:53:46

চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। একটি ঘর ও টয়লেট নির্মাণ ব্যয় এক লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও যেনতেন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে এসব ঘর। ডিজাইন প্রাক্কলন মোতাবেক কাজের গুণগত মানও ঠিক রাখা হয়নি। এক নাম্বার ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দুই ও তিন নাম্বারের ইট। ব্যবহৃত কাঠ, টিনও নিম্নমানের।

এমন সব অভিযোগ নিয়েই শেষ করা হয়েছে গৃহহীন ২২০টি পরিবারের ঘর ও টয়লেট নির্মাণ কাজ। আর এ কারণে নির্মাণের পর একমাস না যেতেই ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে ঘরের ভেতরে। এছাড়া অধিকাংশ পরিবারেরই টয়লেট নির্মাণ কাজ এখনো শেষ করা হয়নি।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টা ভালো কাজ করেছেন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক রাহাত মান্নান।

জানা গেছে, যাদের জমি আছে অথচ ঘর নাই এমন গৃহহীন মানুষদের কথা চিন্তা করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে তাদের জন্য গৃহনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২। এ প্রকল্পের আওতায় চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ৭৫টি, চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ১৪৫টি ও সবশেষ ৯ মে ৪৬০টি পরিবারকে গৃহ ও টয়লেট নির্মাণ বাবদ এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেন সরকার।

প্রকল্পের কার্যাদেশের শর্ত অনুযায়ী আলমডাঙ্গা উপজেলাতে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় বরাদ্দ আসা গৃহনির্মাণ কাজের সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। একই সঙ্গে তৃতীয় দফায় বরাদ্দ আসা আরও ৪৬০টি পরিবারকে গৃহনির্মাণের সময়সীমা বেধে দেয়া হয় ৩০ জুন পর্যন্ত।

কিন্তু দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় আসা গৃহনির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে নামকাওয়াস্তে। অধিকাংশ ঘর নির্মাণে রয়েছে ত্রুটি। ২৭৫ বর্গফুটের ঘর নির্মাণে এক নাম্বার ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দুই নাম্বার ইট। দশমিক ৩৬ এমএমের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দশমিক ৩২ এমএমের ঢেউটিন। নকশায় ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মেঝে ও পিলারে ব্যবহার হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের খোয়া। মাত্র তিনটি রডে বানানো হয়েছে পিলার। ছয়টির বদলে জানালা হয়েছে দুটি।

ঘরের বরাদ্দ পাওয়া আলমডাঙ্গার বেলগাছি ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামের টুটুল মিয়ার অভিযোগ, ঘর নির্মাণে সরকার এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও ঘরের কাজ করা হয়েছে খুব নিম্নমানের। টিন দেয়া হয়েছে কম, ছাউনির বাতাও দেয়া হয়েছে খুব দুর্বল। ঘরের মেজের কাজও দায়সারা ভাবে করা হয়েছে। টয়লেটের কাজও শেষ করে দিয়ে যায়নি শ্রমিকরা।

জামজামি ইউনিয়নের ভোদুয়া গ্রামের আনজিরা বেগমের অভিযোগ, ঘরের বেড়া ও চালে শাল, গর্জন, জারুল, কড়াই, শিশু, তাল, দেবদার বা আকাশমনি কাঠ ব্যবহারের কথা ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র দেবদার আর নিম্মমানের মেহগনি ব্যবহার করা হয়েছে। আর তারকাঁটা, পেরেক, কব্জা, ছিটকানি, স্ক্রু, মেঝের রঙ এসব কিছুই নেয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে। মালামাল আনা-নেয়ার জন্যও তাদেরকে টাকা গুনতে হয়েছে।

নাগদাহ ইউনিয়নের জহুরুলনগর গ্রামের তাবিদা খাতুন বলেন,‘ঘরের সমস্ত মালামাল সরকারের দেয়ার কথা থাকলেও আমাদের গুনতে হয়েছে টাকা। এছাড়া ঘরের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের খাওয়ার টাকাও গুনতে হয়েছে আমাদেরকে। সব মিলিয়ে এই ঘর নির্মাণে আমাদেরও খরচ হয়েছে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা।’

আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার আন্না খাতুন বলেন, ‘নতুন ঘর পেলাম। কিন্তু টয়লেটের পিলার ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এছাড়া ঘরের ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরের ভেতরে পানি জমছে।’

অভিযোগ উঠেছে, নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবধানে ‘পিআইসি’ দ্বারা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) এ ঘরগুলো নির্মাণের কথা। কিন্তু প্রকল্পের নকশা ডিজাইন ও প্রাক্কলনের তোয়াক্কা না করে গৃহহীন মানুষের বাড়ি নির্মাণে নিজেদের ইচ্ছা মতো নিম্মমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। কাগজ কলমে পিআইসি থাকলেও আহ্বায়ক (নির্বাহী কর্মকর্তা) ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা জানেন না কোথায় কোন কাজ হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, গরীবের ঘর নির্মাণ কাজে অনিয়মের অভিযোগটি শেষ পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালকসহ গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্তও। এমন অবস্থায় বেশ কিছু এলাকায় তড়িঘড়ি করে নিম্মমানের টিন বদল করে পুনরায় নতুন টিনও লাগানো হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘কাগজে কলমে আমি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কোথায় কী কাজ হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে তা আমার জানা নাই। এটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।’

আলমডাঙ্গা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে গৃহহীনদের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানদেরও ক্ষোভের শেষ নেই। তাদের দাবি, প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে প্রকল্পের আহ্বায়ক ইউএনওকে সমন্বয় করে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ বিষয়ে চেয়ারম্যানরা কিছুই জানেন না।

তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহাত মান্নান দাবি করেন শতভাগ কাজ ভালো হয়েছে। তিনি সংবাদকর্মীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘অন্য এলাকার তুলনায় আমার এলাকায় কাজ অনেক ভালো হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অনিয়ম তুলে ধরতে পারলে আমি আলমডাঙ্গা থেকে বিদায় নেব।’

প্রকল্পের কাজে এমন দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব ও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন জানান, আলমডাঙ্গায় গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ কাজে অনিয়মের ব্যাপারে ইতোমধ্যে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর