ঢালচরের আর্তি শোনার কেউ আছেন?

, জাতীয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু, স্পেশালিস্ট রাইটার | 2023-08-25 21:10:31

নদীর তীর ধরে হাঁটলে কেবলই ভাঙনের শব্দ, কোথাও কানে আসে কান্নার আওয়াজ। এক স্বজনের নৌকা দ্বীপ ছাড়ার সময় ভিড় জমান অনেক স্বজন। আর হয়তো তাদের দেখা হবে না! এখান থেকে শেষ বিদায়!

সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে, মানুষ ফিরে হাজারো কাজে; কিন্তু এখানকার ভাঙন বিরাম নেয় না কখনোই। বর্ষায় হয়তো ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে, তবে শীতেও থামে না ভাঙন। নিঃশব্দ প্রলয় চলতে থাকে সারা মৌসুম। মানুষগুলো কেবল ছুটছে। আজ ভালো আছে, তো কালই সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে ঘর। সর্বত্র শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। শূন্য ভিটে, ঘরের চালা, বেড়া সরিয়ে নেওয়ার তাড়া। কারও বা তাড়া গাছ কাটার। সমুদ্রের মোহনায় জেগে থাকা দ্বীপ ঢালচরের গল্পটা এমনই। প্রায় চার বছর ধরে একই চিত্র দেখেছি। ভাঙন রোধে এখন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ তো নেই-ই, নিঃস্ব মানুষগুলোর পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেই।

শেষ বিকেলে অপলক উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন মো. জাফর মিয়া। ঢালচরের ভদ্রপাড়ার এ বাসিন্দা শিশুকালে বাবার সঙ্গে এসে এখানেই কাটিয়েছেন জীবনের ৬০টি বসন্ত। ঘর, সংসার, কৃষি, ব্যবসা, বাড়ি, গাছপালা- সবই ছিল এখানে; তবে জীবনের শেষ দিন অবধি তার আর এখানে থাকা হলো না। এরই মধ্যে ঘর সরিয়ে চরফ্যাশনের মূল ভূখণ্ডে চলে গেছেন।

ঢালচরকে কীভাবে মনে রাখবেন? প্রশ্নটা যেন জাফর মিয়ার বুকের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা কষ্টকেই উসকে দিল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, কী ছিল না এখানে? সব ছিল। এখানকার আলো বাতাসে বড় হয়েছি। ঘর সংসার করেছি। বাড়ি করেছি। কৃষির সুযোগ কমে যাওয়ায় মাছের ব্যবসায় নেমেছিলাম। তাতেও মার খেয়েছি।

সব কিছু হারিয়ে এখান থেকে বিদায় নিলেও ঢালচরের স্মৃতি কী হৃদয় থেকে মুছবে কোনো দিন? চোখ মুছতে থাকেন জাফর।

এখানকার ঘরবাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে, ছবি: বার্তা২৪.কম

টাওয়ার বাজার ঘাটে চোখে পড়ল ঘরের সব আসবাবপত্র উঠছে ট্রলারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রলারটি ছাড়বে। নারী ও শিশুরাও উঠেছেন। ঢালচরের আদি বাসিন্দা নূরুল ইসলামের ঘরের সব মালামাল ট্রলারে উঠে গেল। পরে উঠল তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে। ট্রলার ছাড়ার মুহূর্তে ঘাটে আহাজারি। যারা যাচ্ছেন, তারাও কাঁদছেন, যারা কিনারে তারাও। এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি সাইফুল হক হাজি (৬৭), যাকে ছাড়া কোনো সালিস বৈঠক হতো না, যিনি ছিলেন পাঁচটি বাড়ির মালিক। কৃষি জমি ছিল বিপুল। একদিন আগেই তার দুই বোন ঢালচর ছেড়ে চলে গেলেন পরিবার পরিজনসহ। আজ তাই সাইফুল হকের মন খুবই ভারাক্রান্ত। তিনিও থাকতে পারবেন না এখানে। চলে যেতে হবে চরফ্যাশনের কোথাও। সাইফুল হকের নামে একটি মার্কেট ছিল এখানে- হাজী মার্কেট। মার্কেটের পাশের মসজিদটি আর কোথাও সরিয়ে নেবেন না; সরিয়েছেন বহুবার। এখন আর সরানোর জায়গা নেই।

হাজি মার্কেটের শেষ চিহ্নটা যেখানে, সেখানেই ছোট চায়ের দোকান পেতেছিলেন ফারুক বাথান (৪৪)। এ ঢালচরে এসে গড়েছিলেন সব; আবার হারিয়েছেনও। এখন নিঃস্ব। পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই রোজগারের এ ছোট চেষ্টা চায়ের দোকান। তার এ চায়ের দোকানটিও থাকছে না। চলে যেতে হবে ওপারে। সব আয়োজন সম্পন্ন। কতবার দোকান বদল করেছেন- জানতে চাইতেই ফারুক বাথানের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলতে থাকেন, প্রথমে ঢালচর পুরান বাজারে ছিল অনেক বড় মুদি দোকান। এরপর দ্বিতীয় দফায় আসেন টাওয়ার বাজারে। তৃতীয়বার আইয়ূব পাটোয়ারির মার্কেটে। চতুর্থবার হাজি মার্কেটে এবং পঞ্চমবারও একই মার্কেটের আরেক মাথায়। স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে ছোট হতে থাকে তার দোকান। ঢালচরে এমন গল্পের কোনো শেষ নেই। মেঘনার ভয়াল ভাঙন এখানকার সম্পদশালী মানুষগুলোকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। এক একটি পরিবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি বদল করেছে সাত-আট বার। অবশেষে বিদায় ঢালচর।

ঢালচরের অবস্থান সমুদ্রের মোহনায়। দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সর্বদক্ষিণে এ দ্বীপ। এককালে কুকরি মুকরি ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড ছিল ঢালচরে। পরে ২০১০ সালে ঢালচর পৃথক ইউনিয়নের মর্যাদা পায়। তবে এখানে বসতি স্থাপন শুরু হয় ১৯৬২-৬৫ সালের দিকে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। একটি দালানে আশ্রয় নেওয় মাত্র ৮০-৮৫ জন মানুষই বেঁচেছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিকে এখানে আবার জনবসতি বাড়তে থাকে। হিসেবে বলছে, এক সময় এখানে ৩৫শ’ পরিবারের প্রায় ১৭ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। আর বসতি এলাকার আয়তন ছিল ১২ বর্গকিলোমিটার। ২০০৩ সালের পর থেকে প্রবল ভাঙনের ধাক্কায় এ সময়ে দ্বীপটি একেবারেই ছোট হয়ে গেছে। আয়তন এসে ঠেকেছে মাত্র সাড়ে তিন বর্গকিলোমিটারে। আর মাত্র দুই হাজার পরিবারের সাড়ে ১০ হাজারের মত মানুষ মাটি কামড়ে টিকে আছেন ঢালচরে; শেকড়ের কাছে।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ঢালচরের জনজীবনকে নাগরিক সুবিধা থেকে অনেক দূরে রেখেছে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে চরফ্যাশনের কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ঢালচরগামী ট্রলারে উঠে সেখানকার বাসিন্দা আবদুর রহমান বিশ্বাস ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেলেন- যাচ্ছি নেটওয়ার্কের বাইরে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগেও মানুষকে ঘোষণা দিয়ে নেটওয়ার্কের বাইরে যেতে হয়! এ সময়টায় স্বজনদের সঙ্গে থাকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এ হলো ঢালচর। রাতের আঁধার নামলে এ দ্বীপ যেন একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ঢালচর যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌযান। ছোট একটি লঞ্চ চলে বটে; কিন্তু সে লঞ্চও ট্রলারের চেয়ে খুব বেশি বড় না। ফলে বিপদের শঙ্কা থেকেই যায়। তবুও ঢালচরে মানুষদের যেতেই হয়। সেখানেই তাদের ব্যবসা বাণিজ্য, স্বজন, ভিটের শেষ মাটি।

কাঁচা-পাকা কোনো স্থাপনাই রক্ষা পাচ্ছে না ভাঙনের হাত থেকে, ছবি: বার্তা২৪.কম

ঢালচরের অন্তিম সময়ের এ গল্পটি লিখতে বসে আমার মনে পড়ছে চার বছর আগের কথা। তখন আরও অনেক বড় ছিল ঢালচর। সেই হাওলাদার বাজার, সেই টাওয়ার বাজার, বোর্ড অফিস বাজার- এখন আর নেই। প্রথম যখন যাই, সেটা খুব সম্ভবত ২০১৬ সালের গোড়ায়। হাওলাদার বাজারের একটি ভাড়া ঘরে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম চলে। পেছনে একটি থাকার জায়গা ছিল। সেখানেই হয়েছিল আমার থাকার স্থান। তখন ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কাজ শেষের পথে। হস্তান্তর হয়নি। কিছুদিন পরে সেই ভবন হস্তান্তর হয়েছে। অফিস কেবল বসেছিল কিছুদিন। এরই মাঝে ভাঙন কিনারে চলে আসায় সেই নতুন ভবনটি ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে। নতুন ভবনের ছবি যেমন আমার ক্যামেরায় আছে; তেমনি ভেঙে ফেলার দৃশ্য, ভবনটির কংকালের ছবিও ক্যামেরায় ধরার সুযোগ পেয়েছি। ঢালচরের এমন আরও অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী আমি, আমার ক্যামেরা। নোটবুকে রয়েছে সেসব বিবরণ। নোটবুক খুললে যেন এক একজন নিঃস্ব মানুষের আর্তিই শুনতে পাই।

আজ আমার খুব মনে পড়ছে জেবল হকের কথা। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ঢালচরের অতি পুরনো সত্যেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য ৪০ শতাংশ জমি দিয়েছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে সব হারানো এ মানুষটা মুজিব কিল্লার ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, আমি এখন কোথায় থাকব? স্কুলের একটা রুমে আমাকে থাকতে দিতে বলেন না! আমি তার কথার জবাব দিতে পারিনি। তবে সেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, মুজিব কিল্লা, আশপাশের ঘরবাড়ি- কিছুই নেই এখন আর। খানিক দূরে লাইটহাউস কাম রেডিও স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। জমির সীমানাও নির্ধারণ হয়েছিল। ঝুলানো হয়েছিল সাইনবোর্ড। আমার ক্যামেরায় সেসব ছবি জ্বলজ্বল করছে; কিন্তু প্রকল্প এলাকার অস্তিত্ব এখন আর অবশিষ্ট নেই। স্কুলগুলো এক স্থানে জড়ো হয়েছে; ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদারের বাড়ির সামনে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা, হাইস্কুল, গ্রামীণ ফোন টাওয়ার সবই এখন এক স্থানে। এ এলাকাটি বনের কাছাকাছি। ভাঙন এ অবধি চলে এলে ঢালচরের আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।

ঢালচর ভাঙছে, প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। বলা যায় অন্তিমকাল। তবুও এখনো ঢালচরের গুরুত্ব আছে। এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই, ঢালচর থেকে প্রতি বছর অন্তত ২০০ কোটি টাকার ইলিশ পায় দেশ। এখান থেকে আসে সরকারের রাজস্ব। কিন্তু এর বিনিময়ে ঢালচরের মানুষেরা কী পায়? সেই প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আসে; উত্তর মেলে না। আসলে সরকারের এ বিপুল রাজস্ব আয়ের বিনিময়ে ঢালচরের মানুষজন কিছুই চায় না। তারা চায়, জীবিকার অবলম্বন মাছ ধরার সুযোগ আর মাথা গোঁজার ঠাঁই। কীভাবে দেবে এ সুযোগ? হ্যাঁ, এখনও এখানে আছে আশার আলো। সে কথাই বলছিলেন ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদারসহ এলাকার বাসিন্দারা।

ঘরবাড়ি হারিয়ে অচিরেই হয়তো তাকেও চলে যেতে হবে ঢালচর ছেড়ে, ছবি: বার্তা২৪.কম

ঢালচরের মানুষের প্রথমে দরকার মাথা গোঁজার ঠাঁই। তারপর প্রয়োজন ইলিশের ট্রলার ভেড়ানোর জন্য একটি খাল। ইলিশের মাছঘাটগুলো সাধারণত একটি খালকে ঘিরে গড়ে ওঠে। ঢালচরের সব খাল মিশে গেছে মেঘনার স্রোতে। ফলে এ বছর ইলিশের ট্রলার ভেড়ানোর কোনো স্থান এখানে নেই। এ দু’টো সমস্যা সমাধানের জন্য রয়েছে দু’টো পথ। প্রথমত, মানুষের বসতির সমস্যা সমাধানের জন্য বনের পাশে পড়ে থাকা প্রায় তিন হাজার একর খাস জমি ব্যবহার করা যেতে পারে। বনহীন এ খোলা ভূমি পড়ে আছে বছরের পর বছর। এখানে বন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। ফলে অনায়াসে এখানে দ্বীপের নিঃস্ব মানুষদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওই পতিত খাস জমির গা ঘেঁসে আছে একটি খাল; যেটি ইলিশের ট্রলার ভেড়ানোর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ঢালচরবাসী সেটাই চান। পতিত জমিতে জনবসতি গড়ে উঠলে; খালে ট্রলার ভিড়লে বন বিভাগের কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। বরং ঢালচরের সব হারানো মানুষেরা ফিরে পেতে পারে সেই হারানো সুদিন। আসুন না, ঢালচরবাসীর সেই আশার গল্পে পূর্ণতা দিতে উদ্যোগ নেই!

রফিকুল ইসলাম মন্টু: উপকূল-অনুসন্ধানী সাংবাদিক।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর