নির্ভয়া নিসর্গে শঙ্কায় প্রাণিকুল

, জাতীয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু | 2023-08-31 07:28:14

কে ভেবেছিল, এমন খবরও লিখতে হবে! চারিদিকে যেখানে সুনসান নিস্তব্ধতা; জনমানবের কোলাহল নেই; সেখানে প্রকৃতির ভয় কী? সে তো রাহুমুক্ত হয়ে বহুকালের প্রতীক্ষিত দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে। মুক্ত গাছপালা, পশুপাখি। প্রায় মৃত প্রকৃতি যেন জেগে উঠেছে। কিন্তু নির্ভয়া নিসর্গের মাঝেও প্রাণিকুলের সামনে এসে দাঁড়ালো শংকা; ভয়ভীতি। বৃক্ষরাজি আর সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে প্রাণিকুল যখন নতুন করে মিতালি পাতিয়েছে; ঠিক তখনই নিরবতা ভাঙা কান্না। যেন নৃত্য-ছন্দের মাঝেই করুণ সুরধ্বনি বেজে উঠলো। কোথাও ডলফিন হত্যা, কোথাও হরিণ নিধন, কোথাও বা নির্মমভাবে বানর হত্যা। প্রকৃতি-প্রাণিকুলের প্রতি এ কী অবিচার! পূর্ব থেকে পশ্চিম, উপকূল জুড়ে প্রাণি হত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলো করোনা-কাতর মানব মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে।     

কক্সবাজার সৈকতে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা মৃত ডলফিন/ ছবি:সংগৃহিত

প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনা-নিষেধাজ্ঞার পর উপকূল জুড়ে প্রকৃতিতে লক্ষ্য করা গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রাণবৈচিত্র্য যেন নেচে উঠেছে। ডলফিন, কচ্ছপ, শামুক, ঝিনুক, সাগর লতা, বনবাদারের বানর, হরিণসহ গোটা প্রাণীক‚ল যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডলফিনের নৃত্য অবাক করে দিয়েছিল। সেন্টমার্টিনের নির্ভয়া কচ্ছপের দল ফিরিয়ে এনেছিল পুরানো সেইদিন। আশা জাগিয়েছিল সকলের মনে। নতুন প্রাণ নিয়ে জেগে উঠে প্রকৃতিকে আশ্বস্থ করেছিল সুন্দরবন। লাল কাঁকড়ার দলের ছুটোছুটি, বালিয়াড়ির পথ ধরে সাগর লতার লতিয়ে ওঠা যেন এই নিঃসর্গের কাছে বেশ অচেনাই হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতির সে দৃশ্যপট এখন আছে। প্রকৃতি ভয়মুক্ত থাকুক, সেটাই প্রত্যাশা। কিন্তু এর মাঝে দুষ্ট মানুষের দল যে এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল; মেতে উঠল নিধনযজ্ঞে; সেখানেই ভয়। তাহলে কী করোনার ভয় মানুষদের প্রকৃতি সংরক্ষণের শিক্ষাটা এখনও দিতে পারেনি? প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়।

চট্টগ্রামের রাউজানের হালদা নদীতে জেলেদের হাতে নিহত ডলফিন/ছবি: সংগৃহিত

পূর্ব উপকূলের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখেছে ডলফিনের নাচন; ঠিক সেখানেই পড়ে থাকতে দেখা গেছে প্রাণহীন কয়েকটি ডলফিন। ফাঁকা সমুদ্র পেয়ে ডলফিনগুলো চলে এসেছিল সৈকতের খুব কাছে। বাধা পেয়ে থেমে যায় ওদের উল্লাস। আবারও প্রকৃতিকে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র থেকে ভেসে আসে মরা ডলফিন। কতিপয় নির্মম মানুষ হত্যা করে নিরীহ ডলফিনগুলো। অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে জেলেদের দিকে। সমুদ্রে জেলেদের মাছ ধরার জালে ধরা পড়া ডলফিনগুলো আর রক্ষা পায়নি। সাধারণত, মাছের সঙ্গে খেলা করে ডলফিন। মাছের দলের পেছন ছুটে। হয়তো কিছু মাছ ওদের খাবার। জেলেরা যখন মাছের দল ধরার চেষ্টা করে, তখন ধরা পড়ে ডলফিনও। ফলে মারা পড়ে।

ডলফিন হত্যার সবচেয়ে মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞটি ঘটেছে চট্টগ্রামের রাউজানের হালদা নদীতে। ঘটনাস্থল উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ারচর নামক স্থান। হতভাগ্য ডলফিনটির জন্য ৮ মে দিনটাই ছিল শেষ দিন। জালে আটকিয়ে পড়ার পর কতিপয় দুষ্কৃতকারী ৫ ফুট ২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে একটি ডলফিন পিটিয়ে হত্যা করে। তারা ডলফিনটি মেরেই ক্ষান্ত হয়নি; কিনারে তুলে ডলফিনের শরীর কেটে ভেতরের চর্বি বের করে নিয়ে যায়। হালদা নদীর ডলফিন সংরক্ষণ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এর আগেও হালদা থেকে বিভিন্ন সময়ে ২৩টি ডলফিনের প্রাণ সংহার হয়েছে। ডলফিন হত্যার এই হার অব্যাহত থাকলে ডলফিনের অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিয়েই শংকা বাড়ে।  

সুন্দরবনে চোরাশিকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া হরিণ/ছবি:সংগৃহিত

এ বিষয়ে হালদা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্য বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া জানিয়েছেন, ডলফিনটিকে মাথা বরাবর আড়াআড়িভাবে এবং ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য বরাবর কাটা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের এই চিহ্ন বিগত সময়ের মৃত ডলফিনগুলোর চেয়ে একটি নতুন ইংগিত বহন করে। ধারণা করা হচ্ছে, কোন জেলের অবৈধ জালে আটকা পড়লে ডলফিনটিকে পিটিয়ে মেরে ডাঙায় তোলা হয়। পরে কেটে চর্বি বের করার চেষ্টা করা হয়। এই ঘটনাটি হালদা নদীর ডলফিন সংরক্ষণের জন্য একটি অশনি সংকেত বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, প্রচলিত আছে, ডলফিনের চর্বি থেকে তৈল তৈরি হয় এবং সে তৈল এক ধরণের ওষুধে কাজে লাগে। এটার যে মূল্য আছে, সে ধারণাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে হালদার ডলফিন সংরক্ষণ করা যাবে না। এটি একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। এটি খুবই নিরীহ এবং উপকারী প্রাণী। একে সংরক্ষণে জেলেদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে এক সময় হালদা ডলফিন শূন্য হয়ে পড়বে।

শুধু পূর্ব উপকূল নয়, সমগ্র উপকূলেই লকডাউনের কারণে নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে ডলফিনের উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন নদনদীতে ডলফিনের খেলা দেখা গেছে। জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে ডলফিনের এই চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। কোথাও বা ডলফিন ধরে জেলেদের ছবি তুলতেও দেখা যায়। মধ্য উপকূলের শরীয়তপুরের সখিপুর এলাকায় ঘটে এমন ঘটনা। এক জেলে মিঠাপানির ডলফিন বা শুশুক হাতে নিয়ে ছবি তোলেন। আবির মাহমুদ বেলাল নামে একব্যক্তি সে ছবি প্রকাশ করেন সামাজিক মাধ্যমে।

মাদারিপুরে বিষ প্রয়োগে হত্যার শিকার বানর/ছবি: সংগৃহিত

ওই ব্যক্তির স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়, ডলফিনটি ধরা পড়েছিল মোস্তফা মোল্লাহ নামে একজন জেলের জালে। তিনি পদ্মা নদীতে মাছ ধরছিলেন। ছবি তোলার পর শুশুকটি ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেকে বলেছেন এটি মিঠাপানির ডলফিন। যদিও এখানে ডলফিন মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেনি। তবুও নদীতে ঘুরে বেড়ানো একটি ডলফিনকে যখন এভাবে ধরা হয়; ওর ভেতরে ভয় ঢুকে পড়ে। ওর শরীরেও আঘাত লাগে।  

করোনা-নিষেধাজ্ঞায় সুন্দরবন পেয়েছিল অন্যরূপ। পর্যটকদের আনাগোনা নেই, জেলেদের মাছধরা, কাঁকড়া ধরা নেই। নির্বিঘ্নে সুন্দরবন জেগে উঠেছিল আপন মনে। বসন্তের সীমারেখা পেরিয়ে বোশেখের মাতাল সমীরণে বৃক্ষরাজি ফিরে পেয়েছে মাথা তোলার উপযুক্ত সময়। বানরের লাফালাফি, হরিণদলের ছুটোছুটিতে ছিল না কোন বাধা। কিন্তু সেই বাধাহীন দূরন্তপনায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায় চোরা শিকারীর দল। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের মানুষ যখন করোনার ভয়ে কাতর; ঠিক তখন সক্রিয় হয় চোরা শিকারীরা। এদের নিশানা হরিণের পাল। হরিণ শিকারীদের সেই চিরচেনা ফাঁদ। সুন্দরবন এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে বেশ কয়েক দল হরিণ শিকারী আটক করেছে বন বিভাগ। পাওয়া গেছে জীবিত হরিণ, জবাই করা হরিণ, হরিণ ধরার ফাঁদ ইত্যাদি। চোরা শিকারীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আগেই রেড অ্যালার্ড জারি করা হয়েছিল সুন্দরবন এলাকায়। বাতিল করা হয়েছিল বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ছুটি। কিন্তু রেড অ্যালার্ট মানছে না হরিণ শিকারীরা।

মানুষের এই ভয়ের সময়ই দেখতে হলো পনেরোটি বানরের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। করোনা নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে খাবারে বিষ মিশিয়ে মাদারীপুরে পনেরোটি বানর হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে এই বানরদল এক অন্যরকম পরিবেশে বসবাস করছিল। সেখানে গড়ে উঠেছিল এক অভয়ারণ্য। এলাকার কিছু মানুষের অভিযোগ বানরগুলো মানুষের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এদের মধ্যেই কেউ হয়তো ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তবে এ বিষয়ে বন বিভাগ মামলা করেছে। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এই যদি হয় অবস্থা; তাহলে প্রাণিকুল বাঁচতে কী করে?  

সুন্দরবনে চোরাশিকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া হরিণ/ছবি: সংগৃহিত

লকডাউনকালে প্রাণিকুলের ওপর এই নির্মমতাকে কীভাবে দেখছেন? প্রশ্নের উত্তরে সেভ দ্য ন্যাচার অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান আ.ন.ম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরের সী চ্যানেলে ডলফিনের পছন্দের মাছের প্রজননের ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে গভীর সমুদ্র থেকে এ অঞ্চলে দল বেধে শিকার করতে চলে আসে বেশ কয়েকটি ডলফিনের ঝাঁক; যাদের বেশিরভাগ জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা গেছে বলে মনে হয়। জেলেদের সচেতনতা ও কারেন্ট জালের ব্যবহার রোধ এবং জালে আটকে যাওয়া ডলফিন রক্ষায় কি করনীয় তা জেলেদের শেখাতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই হয়তো আমাদেরকে এ মূল্য দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, সারাদেশে নির্বিচারে শুধু বনই উজাড় হয়নি; পাহাড়ও ধ্বংস হয়েছে। এরফলে অধিকাংশ বনেই প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ কম। আরও অনেক সময় দিতে হবে। অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর মধ্যে বানর ছাড়া অন্যসব প্রাণী লোকালয়ে এসে ৮০ শতাংশ প্রাণ হারায়। এদের প্রধান শত্রু মানুষ ও কুকুর। সংকট উত্তরণে বনভূমি ও সামুদ্রিক, উপকূলীয় এবং সমুদ্রতটের জীববৈচিত্র্যের অবস্থানপত্র তৈরি করতে হবে। ইকোসিস্টেমের কোন কোন উপাদান আছে, কোন উপাদান বিলুপ্ত হয়েছে এবং কোন উপাদান বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে সেগুলো থাকবে অবস্থানপত্রে। এ বিষয়গুলো সামনে আনতে না পারলে আমরা করণীয়টা বুঝতে পারবো না। অবস্থানপত্রের ভিত্তিতে পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে।

শরীয়তপুরের পদ্মা নদীতে জেলেদের হাতে ধরা পড়া ডলফিন/ছবি: সংগৃহিত

প্রাণিকুলের ওপর মানুষের এই নির্মম আচরণ প্রসঙ্গে কথা হয় বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহিরউদ্দিন আকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই সময়ে বন্যপ্রাণীর ওপর অত্যাচার বেড়ে গেছে। একদিকে লকডাউনের কারণে চারিদিকে কোলাহলমুক্ত। এই সুযোগটা নিচ্ছে অসাধু চক্র। এ ঘটনাগুলো খুবই দুঃখজনক। প্রথমত এ ধরণের ঘটনা যাতে ঘটতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আর কোথাও ঘটে গেলে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করি। তবে এ বিষয়ে মানুষের সচেতন হওয়া খুবই জরুরি। সচেতনতা বাড়াতে আমরা সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।

সুষ্ঠু, সুন্দর নির্ভয়া পরিবেশ না পেলে তারা বাঁচবে কী করে? প্রাণিকুলের বাঁচার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আর এজন্য মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এই প্রকৃতি, এই বৃক্ষরাজি শুধু মানুষের নয়। নিসর্গ জুড়ে প্রাণিকুলের অংশীদারিত্ব যে সবার আগে।       

রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল-অনুসন্ধানী সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর