আশা নিরাশার দোলাচলে জীবন

, জাতীয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু | 2023-08-30 14:20:57

ঘরের ভিটেয় পড়েছে নতুন মাটি। খড়ের চালা লাগানো হয়েছে মাত্র। এখনও বেড়া দেওয়া হয়নি। ঘরের মালামাল গোছানো, ভিটের মাটি সমান করা, আরো অনেক কাজ। স্ত্রী সাহিদা সেই কাজগুলোই করছিলেন সকাল থেকে। বড় সাইজের একটি কাঠের টুকরো দিয়ে ভিটের মাটি সমান করছেন। এরমধ্যেই দেখতে পেলেন স্বামী আবুল হোসেন মাঝি নদীর ঘাটে থেকে বোঝা মাথায় এগিয়ে আসছেন। খানিক দূর এগিয়ে তার মাথার বোঝাটা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন সাহিদা এগিয়ে নিয়ে এলেন ঘর পর্যন্ত। আবারো তার মনোযোগ ঘরের কাজে।

এমন ঘর গোছানো সাহিদার কাছে নতুন নয়। জীবনে যে কতবার নতুন ঘর করতে হয়েছে, তা বলতে হয় হিসেব করে। রামগতির আলেকজান্ডার ঘাট থেকে ট্রলারে ওঠার সময় আবুল হোসেন মাঝি গুনে গুনে বলছিলেন- পুরানো চর আবদুল্লাহ’র মাটিতে বাড়ি বদল করতে হয়েছে পাঁচবার। সেখান থেকে ষষ্ঠবার সেবাগ্রামে বাড়ি করেন। এরপর সপ্তম বারে যান চর গজারিয়ায়, অষ্টম বার বয়ারচরে, নবম বার চরগাজী এবং দশম বারে ঘুরেফিরে আবার নতুন জেগে ওঠার দ্বীপ চর আবদুল্লাহ।
কথাগুলো বলার সময়ই আবুল হোসেন মাঝি ২-৩ বার স্মরণ করে দিয়েছিলেন তার স্ত্রী বিবি সাহিদার নামটা লিখেছি তো! নিশ্চিত হওয়ার জন্য উঁকি দিয়ে নোটের দিকে তাকান। নদীর ওপারে নোটবদ্ধ বিবি সাহিদার সঙ্গে দেখা এপারে তার নতুন বাড়িতে। কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে সামনে এগিয়ে এসে বললেন- ভালো আছি। তবে এই ‘ভালো আছি’ শব্দ দু’টোর ভেতরে মন্দ থাকারও বেশ ইঙ্গিত পাওয়া গেল। যে জীবনে দশ বার বাড়ি বদল করতে হয়েছে সেটা কতটা ভালো আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

নতুন চর আবদুল্লাহ’র আরও অনেক গল্প আছে। তবে সে গল্পের আগে দ্বীপটির পরিচয়টা জেনে নেই। বহুবার এই এলাকায় ঘুরে একটি বিষয় পরিষ্কার হলো- একদা লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলায় চর আবদুল্লাহ নামে যে ইউনিয়নটি ছিল, সেটি অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে পানির তলায় চলে গেছে। ইউনিয়নের আওতাধীন আশপাশের চর গজারিয়া, তেলির চরে মানুষজন স্থানান্তরিত হয়। ফলে ওই চরগুলোই চর আবদুল্লাহ ইউনিয়ন বলে পরিচিতি পায়। তবে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে সাবেক চর আবদুল্লাহ’র হারিয়ে যাওয়া স্থানে মেঘনার বুকে জেগেছে ভূমি। স্বপ্ন জেগেছে মানুষের মনে। সেখানেই উঠছে নতুন ঘরবাড়ি। অনেকে এটাকে বলেন নতুন চর আবদুল্লাহ।

নতুন ঘরের সামনে বিবি সাহিদা/ ছবি: র. ই. মন্টু

চর আবদুল্লাহ নামটি কীভাবে এসেছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে সাংবাদিক-গবেষক সানা উল্লাহ সানু রচিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘লক্ষ্মীপুর ডায়েরি’ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ১৮৫৪ সনে দেশের বৃহত্তম নদী মেঘনার বুক থেকে জেগে ওঠা অসংখ্য চরের একটি এটি। কয়েক বছর পর সে চরেও জরিপ পরিচালনা করে ব্রিটিশ সরকার। এ জরিপ পরিচালনাকারীদের অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ নামক এক কর্মকর্তা। স্থানীয়দের দাবি ওই কর্মকর্তার নামানুসারে এ চরের নামকরণ করা হয় চর আবদুল্লাহ। কারো কারো মতে, এ চর ও চরগজারিয়ার এক সময়ের প্রভাবশালী বসতি স্থাপনকারী কৃষক আবদুল্লাহ’র নামানুসারে চরের নাম রাখা হয়। কিন্তু সেই চর আবদুল্লাহ ভেঙে চুরমার।

ট্রলার থেকে নেমে খানিক দূরে বসতি এলাকা। হাঁটছি উড়ি ঘাস মাড়িয়ে। স্লিপার জোড়া ট্রলারে রেখে আসায় খালি পায়ে হাঁটা কঠিন। আমার সঙ্গী তিনজন। একজনের নাম আগেই বলেছি; আবুল হোসেন মাঝি। আরেকজন শফিউল্লাহ’র ছেলে কিশোর রাফি; দ্বীপে এসেছে বাবার কৃষি কাজে সাহায্য করতে। আরেকজন কিশোর উজ্জল দ্বীপের বাথান, মহিষ চড়ায়। ওরা হাঁটছে দ্রুত পায়ে। উজ্জলের পায়ের প্লাস্টিকের চটি আমাকে সাহায্য করল। দ্বীপের বসতিতে প্রথমেই সামনে পড়ল আবুল হোসেন মাঝির নতুন ঘরটি। এখানে খুব বেশি বাড়িঘর নেই। ছড়ানো ছিটানো কিছু ঘর। লোকজন কেবল আসতে শুরু করেছে মাত্র বছর পাঁচেক আগে থেকে। দ্বীপের প্রথম বাসিন্দা হাজী আলী হোসেনের ছেলে নাজিম উদ্দিন এখানে বাড়ি করেন পাঁচ বছর আগে। একে একে আসেন অন্যান্যরা। কেউ কেউ আবার এখনও বসবাসের জন্য ঘর তোলেননি। কৃষিকাজের প্রয়োজনে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

ঝুপড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শাহনাজ বেগম/ ছবি: র. ই. মন্টু

এখানে এসে কীভাবে ঘর করেছেন? এ জমি কার? প্রশ্ন করতেই আবুল হোসেনের উত্তর- এটা আমাদের ভিটে। বাপদাদার জমি এখানেই হারিয়েছি কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে। অনুমান করে এসে সেই জমিতে ঘর করেছি। এখানে আমাদের অধিকার আছে। 

তিনি জানালেন, এখানে যারা এসেছে সকলের একই অবস্থা। এরা সবাই বেশ কয়েকবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। সবাই সাবেক চর আবদুল্লাহ’র বাসিন্দা। চরের খোলা মাঠ পড়ে আছে। এখানে বসবাসে আমাদের অনেক কষ্ট। তবুও আমরা আসতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। কথা বলতে বলতে যেন পুরানো স্মৃতিগুলোই ভেসে ওঠে আবুল হোসেন মাঝির মনে। চোখ ছলছল। বলতে থাকেন- প্রত্যেকবার ঘর বদলাতে ৫০-৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা খরচ হয়। কোথায় পাই আমরা এত টাকা! সরকার তো কিছুই দেয়নি। আয়-রোজগারের একটি মাত্র অবলম্বন মাছধরা নৌকা। দুই ছেলে মাছ ধরে।

আবুল হোসেন মাঝির ঘরটা পেছনে রেখে খানিক সামনে এগোতেই শফিউল্লাহ’র মুখোমুখি। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসেছেন অনেক দূর থেকে। ট্রলার চালক মোকাম্মেল হোসেন তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন, দ্বীপে সাংবাদিক এসেছে। তাই তিনি এসেছেন কিছু বলতে। মোকাম্মেলের ট্রলার যাবে চরের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। তার খুবই তাড়া। চর থেকে মহিষের দুধ নিয়ে ওপারে ফিরতে হবে ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে। ট্রলার থেকে আমাকে চরের এ প্রান্তে নামিয়ে দেওয়ার সময় তিনি বার বার সেই তাগাদাই দিয়েছেন। দ্বীপে যে কয়জন মানুষ আছেন, তাদের মধ্যে শফিউল্লাহ মোটামুটি লেখাপড়া জানা। এখানে কৃষি আবাদের জন্য আসেন। স্থায়ীভাবে থাকেন না। চরের উর্বর জমিতে কৃষি খামার করেছেন। সেখানে রয়েছে ছোট্ট একটি বাসা। দু’দিন আগে এসেছিলেন স্ত্রী পারভীন আক্তারকে নিয়ে। শফিউল্লাহ জানালেন, এখানকার জমি উর্বর। এখানে মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী জায়গা রয়েছে। কিন্তু একদিকে মহিষের তাণ্ডব, অন্যদিকে দস্যুদের ভয়। নাগরিক সেবার তো কোনোটাই নেই। এই দুর্গম জনপদে সে সুযোগ থাকার কথা ভাবাও যায় না।

স্কুল ছুট কিশোরী জামেলা/ ছবি: র. ই. মন্টু

খানিক এগোতেই একস্থানে কয়েকটি ঘর। ঠিক ঘর বলা যায় না, ঝুপড়ি। খড়ের ছাওয়া দুটি চালা একত্রিত করে পাতার বেড়া দিয়ে রাত কাটানো মাত্র। ঘরের বাইরে মাটি খুঁড়ে বানানো চুলোয় রান্না হয়। মানুষগুলোর অনেকে সকালের কাজ কর্ম সেরেছেন মাত্র। খাওয়া দাওয়া তখনও হয়নি। বাচ্চাদের কারো আড়মোড়া ভেঙেছে কেবলই। বাইরে অনেক লোকজনের কথা শুনে শিশুরা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আশপাশের সকলে এসে জড়ো হয়ে প্যান্ট পড়া ক্যামেরাওয়ালা লোকটাকে দেখছে। বুঝতে চাইছে তার তার আসার উদ্দেশ্য। শহুরে প্যান্ট পড়া লোক দেখে দ্বীপের মানুষগুলো অনেকটা বিস্মিত হয়ে গেল। দূর থেকে অনেকে দ্রুত পায়ে ছুটে এলেন। কারো মনে কিছুটা ভয়ও। এ যেন তাদের কাছে এক অবাক করা সকাল। গলায় ক্যামেরা ঝুলতে দেখে আগ্রহের মাত্রা আরেকটু বেড়ে যায়। যেখানে কখনোই শহুরে লোকজন দেখেনি তারা, সেখানে এই সকালে এ আবার কে? চোখে মুখে যেন এমনই প্রশ্ন সকলের। প্রশ্ন না পেলেও আমি ব্যাখ্যা করি পরিচয় এবং আসার কারণ।

জড়ো হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে একজন শাহনাজ বেগম। স্বামী আবুল কালাম। ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে বললেন, ঘর নাই। দুয়ার নাই। মরুভূমিতে থাকি। জমি নদীতে ভেঙে গেছে। থাকার কোনো জায়গা নেই। নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছি।

শাহনাজের পাশে দাঁড়ানো বিবি নূরজাহান বললেন, আমরা নদীভাঙ্গা। জায়গা জমি নাই। কই যামু। বিপদে পইড়া চরে আইছি। আমাগো জমি তো এইখানেই ছিল। নদীতে হারাইয়া গেছিল। আবার জাইগা উঠছে। হলদে চেক শাড়ির ঘোমটাটা আরও খানিকটা সামনের দিকে টানতে টানতে সাহেব আলীর বিধবা স্ত্রী বিবি আমিরজান বললেন, স্বামী হারানোর পর খুবই বিপদে আছি। স্বামীও নাই, জমিজমাও নাই। দুটো ছেলে আছে। তারা ছোট। চেয়ে চিন্তে খাই। ধানের মৌসুম এলে ধান কুড়াই। বাইরের কাজকর্ম করি। এভাবেই চলি।

এতোগুলো মানুষের ভিড়ে দর্শকের ভূমিকায় আছে কয়েকটি শিশু। বড়দের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বোঝার চেষ্টা করছে। ওরা জানে এখানে ওদের কোনো ভূমিকাই নেই। কেউ কেউ কাছে এসে ক্যামেরার লেন্সটা একটু ছুঁয়ে দেখতে চায়, ক্যামেরাটা ধরতে চায়। কেউবা দ্বীপে আসা নতুন মানুষটাকেই দেখে। একজনকে জিজ্ঞেস করি- নাম কী? উত্তর- জামেলা। স্কুলে যাও? উত্তর- না। ওর পাশে দাঁড়িয়ে রাকিব, আরিফ, লাকী, সাকিবসহ আরও কয়েকজন। শেষের উত্তরটা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। না, ওরা কেউই স্কুলে যায় না। স্কুলে যাওয়া, না যাওয়ার প্রশ্নটাই এখানে অবান্তর। কেননা, এই দুর্গম দ্বীপে আপাতত স্কুল থাকার সুযোগ নেই।

খামার পরিচর্যায় মো. শফিউল্লাহ/ ছবি: র. ই. মন্টু

দ্বীপের পুরানো বাসিন্দাদের মধ্যে একজন আবদুল মতিন। বয়স ৬৫ ছাড়িয়েছে। ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। লোকজনের ভিড় দেখে এগিয়ে এলেন। সাবেক চর আবদুল্লাহ’র মাটিতে এক সময় বিপুল সম্পদশালী এই মানুষটা এখন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কাতারে। সত্তরের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে উপকূলীয় জনপদের অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। আমাকে দেখে কিছুটা বিস্মিত। হয়তো চেনা চেনা লাগছে। মনে করতে পারছিলেন না। খানিক বাদে মনে পড়তেই বললেন, স্যার, আপনাকে সেবছর তেলির চরে দেখেছি। অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে সে দৃশ্য। তার জীবনে লড়াই শুরু হয়েছে ছোটবেলা থেকে। হয়তো শেষ দিনটি পর্যন্তই লড়তে হবে। তার আতিথেয়তা, ঘরে বসার আমন্ত্রণ রাখার সুযোগ হলো না। খাওয়াতে চাইলেন অন্তত একটা ডিম ভাজা। বললাম, পরের বার এসে খাবো। বলতে বলতে শফিউল্লাহ’র সঙ্গে হাঁটছি খামারের দিকে। কিছুক্ষণ পর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে আসছেন মতিন। হাতে প্লেট। ডিম ভেজে নিয়ে এসেছেন। আমি দাঁড়াই। আমার চোখ ভিজে ওঠে। ভাবি, এমন দুর্গম দ্বীপে কষ্টে থাকা মানুষেরাও যে কতটা আন্তরিক হতে পারে আবদুল মতিন উদাহরণ।

খানিক দূরে শফিউল্লাহ’র কৃষি খামার। কুমড়ো ক্ষেত দেখাতে নিয়ে গেলেন। ফাঁকে ফাঁকে সারিবদ্ধ সূর্যমুখী বুনেছেন। চারিদিকে শক্ত করে দেওয়া হয়েছে কাঁটা তারের বেড়া। উর্বর জমি। ফলনও ভালো হয়। কিন্তু মহিষ আর দস্যুদের ভয় আছে। মহিষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক টাকা খরচ করে শক্ত বেড়া দিয়েছেন। ফলন ঘরে তুলতে পারলে লাভবান হবেন। তবে শেষ অবধি কী হয় জানেন না শফিউল্লাহ। দস্যু আর মহিষের সঙ্গে লবণ পানির ভয়ও আছে। শফিউল্লাহ’র কৃষি নিয়ে দু:শ্চিন্তা, কারো ভয় বসতি নিয়ে, কারও রোজগার নিয়ে। এভাবেই আশা-নিরাশার দোলাচলে এভাবেই বাঁচেন দ্বীপের পোড় খাওয়া মানুষেরা। ট্রলার চালক মোকাম্মেল হোসেনের ফোন আসে কয়েকবার। ঘাটে যাওয়ার তাড়া। সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো পথে হাঁটি দ্রুত পায়ে।

রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল-অনুসন্ধানী সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর