প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল যে ম্যানগ্রোভ

, জাতীয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু | 2023-08-31 14:54:00

‘এই বনই তো আমাগো বাঁচাইয়া রাখছে। বনটা না থাকলে আরও কয়বার যে ভাসতে হইতো! কে জানে।’ সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের মুখে সব হারানো ক’জন প্রবীণ মানুষ এভাবেই ম্যানগ্রোভ বনের সুরক্ষা দেয়ালের কথা তুলে ধরছিলেন। বললেন, এই বন তো আমাদের আগলে রাখে। বড় বড় ঝড়ঝাপটা আমাগো গায়ে লাগার আগে বনের গায়ে লাগে। কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ মুছতে থাকেন নব্বই পেরোনো আবদুল কাদের মাল। সেদিনের ছবি যেন তার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছিল। কথা বলতে গিয়ে সেদিনের দৃশ্যপট এঁকেছিলেন চোখের সামনে।

ছবি
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্ব হারানো আবদুল কাদের মাল/ ছবি: র. ই. মন্টু

বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়েছেন আবদুল কাদের মাল। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের সময় তখন চল্লিশের টগবগে যুবক তিনি। অল্পদিন আগেই বিয়ে করেছিলেন। ঘরে এসেছিল এক ফুটফুটে ছেলে সন্তান। সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়ে সব গিয়েছে এলোমেলো হয়ে। গাছের ডালপালা ধরে প্রবল বাতাস আর তুফানের সঙ্গে লড়াই করেও শেষ রক্ষা হয়নি। পারেননি স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচাতে। তবে রক্ষা পেয়েছে নিজের জীবন। সেই মহাপ্রলয় থেমে যাওয়ার পর জীবন শুরু হয় আবার নতুন করে; একদম শুন্য থেকে। গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখা তার সাথে। রাস্তার মোড়ের দোকানের সামনে আলাপ নানান বিষয়ে। উদোম শরীর; কোমড়ে বাঁধা নীল চেক গামছা। কথা বলার সময় দু’হাতে ঘটনার তীব্রতা বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

বাড়ি তার উত্তর চর মানিকা গ্রামে। এটি দ্বীপ জেলা ভোলার দক্ষিণে চরফ্যাসন উপজেলার একটি গ্রাম। গ্রামের রাস্তার মোড়ে কয়েকটি দোকান। আলাপের সময় জড়ো হলেন আরও কয়েকজন। রাস্তার ত্রিমোহিনীতে আবদুর রশিদ ঢ়ারি’র দোকানে আড্ডায় আরও ক’জন বয়সী মানুষ। মফিদুল ইসলাম (৫৪), আরেকজন ফজলে করিম (৬৬), সাহাবুদ্দিন মিয়া (৬২)। তারা আরও কিছু ঘটনা যোগ করে কাদের মাল’র আলাপে সাহায্য করেন। দোকানদার রশিদ ঢ়ারিও বললেন কিছু ঘটনা। এদের প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে সেদিনের প্রলয়ের চিহ্ন। সেই ভয়াল ছবি আর মনে করতে চান না তারা।

ছবি
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির শিকার আবদুর রশিদ ঢ়ারি/ ছবি: র. ই. মন্টু

সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে এত ক্ষতি হওয়ার কারণ কী ছিল? প্রশ্ন ছুঁড়তেই এদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, বেড়িবাঁধ ছিল না; গাছপালা ছিল না। বাড়িঘর ছিল অরক্ষিত। অতিমাত্রার উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কেউই তো হারানো সম্পদ আর ফিরে পায়নি। পারেনি ঘাটতি পূরণ করতে। একজন আক্ষেপ করে বললেন, এখন যে বন আছে; এমন বন আগে থাকলে সেদিন কিছুই হারাতে হতো না। এখন কীভাবে নিরাপদে আছেন? প্রশ্নের উত্তরে রশিদ ঢ়ারি বললেন, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের পর অনেক স্থানে ম্যানগ্রোভ বন করা হয়। পঞ্চাশ বছরে সে গাছপালা অনেক বড় হয়েছে। এসব বন এখন আমাদের ঢাল। বনের কারণে ঝড়-ঝাপটা আমরা টের পাই না। কাদের মাল বলেন, তখন বন থাকলে আমার বউটা, পোলাটা বাইচ্যা থাকতো।

কোন বনের কথা বলছেন? কোন বন বাঁচিয়ে রাখছে এই এলাকার মানুষদের? প্রশ্ন করতে একজন বলে ওঠেন- কুকরি মুকরি বন। এই ছবিটা শুধু উত্তর চর মানিকা গ্রামের নয়। ঠিক একই কথা বলেছেন আশাপাশের অন্যান্য গ্রামের মানুষেরাও। চর মানিকা, আইচা, দক্ষিণ আইচা, কচ্ছপিয়া, শশীভূষণ, চর কলমী, বাবুরহাট, ঘোষের হাট, আনজুরহাটসহ গোটা চরফ্যাসন উপজেলা; এমনকি ভোলা জেলাকেও আগলে রাখে কুকরি মুকরির ম্যানগ্রোভ। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে এ অঞ্চল যেভাবে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিল; ঠিক তেমনি এখন এই অঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম বাঁচিয়ে রাখছে বন। বন থাকায় মানুষের মনে সাহস বেড়েছে। গত কয়েক বছরের বড় ঝড় ঝাপটাগুলো তাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তাই এই এলাকার মানুষ সিগন্যালকে এখন আর ততটা ভয় পায় না। মানুষজন বুঝতে পারছে বনের প্রয়োজনীয়তা। তাই তারা নিজেরাও বাড়িতে লাগাচ্ছে প্রচুর পাছপালা।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বিগত প্রায় ৫০ বছরে কুকরি মুকরি ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে গড়ে উঠেছে। বনের বৈচিত্র্য আর পরিধি বিবেচনায় এটাকে এ বন ‘দ্বিতীয় সুন্দরবন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আট হাজার ২৪৯ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত কুকরি মুকরি ইউনিয়নের গোটা এলাকাটি ঘিরে রেখেছে বনাঞ্চল। যে কোন দিক দিয়ে এ দ্বীপে যেতে হলে আঁকাবাঁকা সরু খালের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। বছরের প্রায় সারা মৌসুমই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য এখানে বহু মানুষ বেড়াতে আসেন। কুকরি মুকরির দশ সহস্রাধিক মানুষকে নিরাপত্তা দিয়ে এ বন প্রভাবিত এলাকার বহু মানুষ এবং সম্পদের সুরক্ষা দিয়ে আসছে যুগের পর যুগ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ ম্যানগ্রোভ না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতো। এখন ঝড়ের ঝাপটা কম লাগে। মানুষ নিরাপদে আছে।

ছবি
কুকরি মুকরি ম্যানগ্রোভ বন/ ছবি: র. ই. মন্টু

সূত্র বলছে, ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গিয়েছিলেন কুকরি মুকরি দ্বীপে। সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাপক বনায়নের তাগিদ দেন। সেই থেকে বন বিভাগ এখানে বনায়ন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। বন বিভাগ ও স্থানীয় জনসাধারণের যৌথ চেষ্টায় দিনে দিনে বনের পরিধি বাড়তে থাকে। এখন এখানে বনের আয়তন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর। কেওড়া, ছৈলা, গেওয়া, গড়ান, সিংড়া, সুন্দরী, বাইন, খলসে, গোলাপাতাসহ নানান জাতের গাছপালা রয়েছে এখানে। বন জুড়ে হরিণ, বানর, ভোদর, শিয়াল আর নানান জাতের পাখিদের রাজত্ব। যতদূর জানা যায়, আশির দশকের আগে এ বনে দস্যুদের রাজত্ব ছিল। তখন বন সুরক্ষায় অনেক সমস্যা ছিল। পরবর্তীদের দস্যুরা পালায়, বনের ব্যবস্থাপনায় আসে আমূল পরিবর্তন। বন এলাকার বাইরেও কুকরি মুকরি দ্বীপের চারিদিকে নির্মিত বেড়িবাঁধের দু’ধারে গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। ফলে গোটা দ্বীপটি সবুজে ভরে উঠেছে।

উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় যখন বন ধ্বংসের হিড়িক; তখন কুকরি মুকরির বন কীভাবে ধ্বংস না হয়ে বরং আরও প্রসারিত হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বন বিভাগের কুকরি মুকরি রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এক সময় বন সুরক্ষার ক্ষেত্রে এখানে অনেক ধরণের সমস্যা ছিল। দস্যুদের উৎপাত ছিল। জেলেরা বনের গাছপালা কেটে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করতো। খুটা জালের জন্য অনেক গাছ কাটা হতো। সেগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো হয়েছে। বন সুরক্ষার জন্য এখানে বেশ কয়েকটি কৌশল নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে বন বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার, মানে ইউনিয়ন পরিষদ যৌথভাবে কাজ করায় বন সুরক্ষা সহজ হয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর এর দু’ধারে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্থানীয় জনসাধারণের দিক থেকে প্রতিরোধ আসে। কোনভাবেই তারা রাজি হচ্ছিল না। পরে ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা নিয়ে গাছ লাগানো হয়েছে।

কুকরি মুকরির বন কীভাবে প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল হয়ে উঠল? প্রশ্নের উত্তরে কুকরি মুকরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, এই বন সৃজনের আগে মধ্য উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ঝুঁকিতে ছিল। কিন্তু এখন এ বন এতদঅঞ্চলে প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে কাজ করছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এই বনটি না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হতো। এখন তো ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল আসে। ফলে জনজীবনের জন্য এ বন বেশি উপকারী। বন সুরক্ষার প্রধান ম্যাজিকটা হলো, মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো। এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ ও বন বিভাগ থেকে ব্যাপক কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। বনের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে বোঝানো হয়েছে। বনের ক্ষতি সাধিত হয়, এমন কোন কর্মকান্ড এখানে নিষিদ্ধ। বনের খালে মাছ ধরায় বিধিনিষেধ আছে। পাখি সংরক্ষণ, অতিথি পাখিদের অবাধে বিচরণের সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। এখানে পর্যটক এলেও বনের যাতে ক্ষতি করতে না পারে; সে বিষয়ে আমরা নজর রাখি। এসবের মধ্যদিয়েই সুরক্ষিত রয়েছে কুকরি মুকরি ম্যানগ্রোভ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কুকরি মুকরির বন সুরক্ষার এই দৃষ্টান্ত উপকূলের সর্বত্র প্রয়োগ করতে পারলে উপকূল জুড়েই প্রাকৃতিক দেয়াল গড়ে উঠতে পারে। এজন্য জনসচেতনতার সঙ্গে নিতে হবে কিছু কৌশল। এর মধ্যদিয়ে মানুষ ও সম্পদ নিরাপদ থাকতে পারবে; সুরক্ষিত থাকবে উপকূল।

রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল-অনুসন্ধানী সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর