দুর্যোগের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে উপকূলবাসী?

, জাতীয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-30 23:53:31

ভর দুপুরে নিস্তব্ধ চারিদিক। লোকশূন্য রাস্তাঘাট। পাশের নদীতে বয়ে চলে কয়েকটি মাছ ধরার নৌকা। বনের ধারে গাছের ডালে পাখিদের কিচির মিচির ডাক কানে আসে।

সেই সকাল থেকে কাজে বিরাম নেই ইলিয়াস হোসেন এবং তার স্ত্রী মর্জিনা বেগমের। চারখানা বাঁশের খুঁটি জোড়া লাগাতে না পারলে রাতে ঘরে থাকার উপায় নেই। নড়বড়ে খুঁটিতে কেটেছে অনেক দিন। বাঁশের খুঁটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুর্যোগে খাপ খাওয়ানোর অভিনব এক গল্প।

এই ছবিখানা আমার নোটবুকে উঠেছে পশ্চিম উপকূলের খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রাম থেকে। এই গ্রামের শত শত বসত ঘর এভাবেই ঝুলে আছে এই বাঁশের খুঁটির সঙ্গে। খুঁটির সঙ্গে জোয়ার সমান পাতা হয়েছে কাঠের পাটাতন। এর ওপরেই বসতি বছরের পর বছর। না, এই এলাকার মানুষদের কেউ শিখিয়ে দেয়নি এই কৌশল। এরা দুর্যোগের কাছে শিখেছে, এখানে বসবাস করতে হলে এভাবেই ঘর বাধতে হবে। এই গ্রামের সবগুলোর বাড়ি এক সময় ছিল ভূখণ্ডে; মাটির ওপরে। প্রয়োজন ছিল না মাচা পাতানোর। ঘরের সামনে উঠোন ছিল। সেই উঠোনে খেলত শিশুরা। ঘরের আশপাশে ছিল সবজির বাগান। কিন্তু সেসব কেড়ে নিয়েছে ২০০৯ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা। সে কথাই বলছিলেন ঝুলন্ত গ্রামের বাসিন্দা বনজীবী ইলিয়াস হোসেন।

কালাবগি গ্রামে ঝুলন্ত ঘরের সামনে মোনায়ের সরদার/ ছবি: র. ই. মন্টু

‘এই যে শিবসা নদীর ঢেউ দেখছেন; এখানেই ছিল আমার ঘর। কাজকর্ম করে দিনগুলো ভালোই চলছিল। সামান্য জমি ছিল। চাষাবাদ করতাম। কিন্তু আইলা এসে আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেছে। আমরা ভিটে হারিয়েছি। এখন আয় রোজগারের পথও বন্ধ। থাকার ঘরও নেই। শেষে এভাবে ঘর বানিয়ে থাকছি। কই যাব? এখানে থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই। জোয়ারের পানি ওঠে; তাই পাটাতন উঁচু করে নিয়েছি। এখন এটাই আমাদের ঘরবাড়ি।’

দুর্যোগ থেকে বাঁচতে কালাবগি গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই কৌশল বের করে নিয়েছে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে যখন মাথা গোঁজার আর কোন পথ ছিল না; তখন পানির ভেতরেই ঘর বেধেছে বিশেষ কায়দায়। সমগ্র উপকূল জুড়ে রয়েছে দুর্যোগে টিকে থাকার এমন অনেক গল্প। যেখানকার মানুষের ঝুলন্ত ঘর করার সুযোগ নেই; সেখানে ঘর তৈরি হয় উঁচু ভিটেয়। দুর্যোগ থেকে বাঁচতে কেউ ঘরের চারপাশে রশি টানা দেয়। দুর্যোগকালে সহজে যাতে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে পারে; এমন কৌশলও রাখে তারা। ঘরের প্রয়োজনীয় মালামাল সংরক্ষণে কাঠের বড় বাক্স রাখে প্রত্যেক ঘরে।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহর তেলির চরের রুহুল আমীন মৃধাকে (৭০) জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঘরের ভিটে এতখানি উঁচু করেছেন কেন? উত্তরে বললেন, ‘এই যে চরের যত জমি দেখছেন; সবখানে পানি ওঠে। ঘরের ভিটে প্রায় সাত ফুট উঁচু। এরপরও পানি ঘর ছুঁই ছুঁই হয়ে যায়। কী করি, আমাদের তো কোনো উপায় নেই। জোয়ারের পানির বিপদে পরেই তো আমরা নিজেরা শিখে নিয়েছি; এভাবে বাঁচতে হবে। আমাদের তো আর কোনো উপায় নেই। কতবার যে বাড়িঘর নদীতে গেছে; হিসাব নাই। এইখানে বনজঙ্গলের মধ্যে এসে ঘর বানিয়েছি।’

ঠিক আমীন মৃধার ঘরের মতই দ্বীপচরের ঘরগুলোর ভিটে উঁচু থাকলেও ঘরের চালা থাকে বেশ নিচু। এর কারণ কী- আমীন বলেন, ‘ঝড়ে যেন ঘরের চালা উড়িয়ে নিতে না পারে; সেজন্য এ কৌশল।’

দুর্যোগ থেকে বাঁচতে ঘরের চারপাশে রশি টানা দিয়ে শক্ত করার কৌশল নেয় উপকূলবাসী। ঝড়-বাদলে ঘর যাতে হেলে পড়তে না পারে; ধ্বসে যেতে না পারে; অথবা ঘরের চালা উড়ে যেতে না পারে; সেজন্যেই এ ব্যবস্থা। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় এমন কিছু ঘর চোখে পড়ে।

বসতির উঁচু ভিটে তৈরি হচ্ছে চর আবদুল্লাহয়/ ছবি: র. ই. মন্টু

পূর্ব উপকূলের কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার দক্ষিণে তাবালর চর এলাকায় এমন অসংখ্য ঘরে দেখা গেছে। সমুদ্রের খুব কাছে এবং বেড়িবাঁধ খুবই নিচু হওয়ায় ঘরগুলো নিরাপদ রাখা কঠিন। ঘরের চারিদিক দিয়ে চালা প্রায় মাটির সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে; যাতে ঝড়ে ক্ষতি করতে না পারে। এখানেই শেষ নয়। ঘরগুলোর চালার ওপরে কালো রঙের পলিথিন দিয়ে ইট দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে। ঘরের চার কোণায় রশি টানা তো আছেই। শুধু কুতুবদিয়ায় নয়, দুর্যোগ মৌসুম এলে উপকূলের বিভিন্ন এলাকার মানুষের এভাবে ঘর গোছানোর প্রস্তুতি শুরু হয়।

দুর্যোগ থেকে বাঁচতে উপকূলের মানুষ ঘরের মাচার পাটাতন কিছুটা ফাঁকা রাখে। কেন এ কৌশল? প্রশ্নের উত্তরে তেলির চরের বশির উদ্দিন (৫৫) বলছিলেন, ‘জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বাড়লেও ঘরের মানুষ যাতে রক্ষায় পায়; সেজন্যে এ ব্যবস্থা। দুর্যোগের সময় ঘরের চালাগুলো আলগা করে রাখি। যাতে পাটাতনের ফাঁকা দিয়ে ওপরে উঠে অনায়াসে চালার ওপরে ওঠা যায়। চালা যেহেতু পানিতে ভাসবে; চালার ওপরে বসে থাকলেও মানুষগুলো বাঁচতে পারে। এই চিন্তা থেকেই এমন কৌশল।’

এই পদ্ধতিতে প্রবল দুর্যোগের মধ্যেও বেঁচে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছিলেন চর পাতিলার আয়নার হোসেন। তিনি বলেন, ‘সিডরের সময় তো চরের সব বাড়ি ডুবে গিয়েছিল। সিরাজউদ্দিন নামের একজন চরবাসী পরিবারসহ ঘরের চালায় উঠেছিল। ঘরের চালার ওপর ভাসতে ভাসতে সিরাজ বলছিল, ভাইরে যাচ্ছি, আমাদের জন্য দোয়া কইরো। পরে দেখা গেল, চালায় ভেসে থাকার কারণেই বেঁচে গেছে পুরো পরিবার।’

ঘরের চালার চারপাশে অনেকগুলো বড় সাইজের পানির ড্রাম রেখে দিয়েছিলেন দ্বীপ জেলা ভোলার দৌলতখানের দ্বীপ ইউনিয়ন মদনপুরের বাসিন্দা কাঞ্চন আলী। ঘরে ঢুকতেই সেগুলো চোখে পড়ে। প্রশ্ন জাগে, এতগুলো ড্রাম কেন? জানতে চাই কাঞ্চন আলীর কাছে। তার কথায় যেটা বোঝা গেল, এই ড্রামই দুর্যোগ থেকে বাঁচার অভিনব কৌশল। তিনি বলেন, ‘আমরা তো নিয়তির ওপর ভরসা করেই বাঁচি। এখানে তো আমাদের রক্ষা করার কেউ নেই। তবুও নিজেরা কিছু ব্যবস্থা রাখি। এই ড্রামগুলো ব্যবহার করতে পারি জলোচ্ছ্বাসের সময়। পরিবারের সবাই একটা-দুইটা করে ড্রাম ধরে ভেসে থাকতে পারলে বেঁচে যাবে।’

কাঞ্চন আলীর ঘরের এই ড্রামগুলো দেখার পর উপকূলের অনেক স্থানেই বসতি ঘরে চোখে পড়েছে এমন সারি সারি ড্রাম; যা উপকূলের মানুষদের বিপদ থেকে বাঁচায়।

উপকূলীয় অঞ্চল ঘুরলে অধিকাংশ ঘরেই দেখা যাবে বড় সাইজের কাঠের বাক্স। কেউ কেউ এটাকে, মিটকেস বা মিটসেফ বলেন শুনেছি। কাঠের এই বাক্সটা নাকি দুর্যোগ থেকে মালামাল রক্ষার কৌশল হিসাবে কাজ করে। কিন্তু কীভাবে? সে কথাই বলছিলেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর পাতিলার বাসিন্দা মিনারা বেগম। দুর্যোগকালে এই বাক্সটির কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঘরের সব খুচরো মালামাল আমরা এই বাক্সে রাখি। মূল্যবান যা কিছু; এটার ভেতরেই থাকে। যদি কখনো বিপদ হয়ে যায়, ঝড়ের মধ্যে পড়ি, তাহলে এই বাক্সের মালামালগুলো ভালো থাকবে। এত ভারি বাক্স হয়তো সহজেই উড়ে যাবে না। অন্তত ঝড়ের পরে খুঁজে পাব।’

তার কথা থেকে বোঝা গেল, এই বড় বাক্সটা দুর্যোগকালে ঘরের মালামাল সংরক্ষণে যথেষ্ট সহায়ক।

ঘরের মালামাল রাখার কাঠের বাক্স/ ছবি: র. ই. মন্টু

দুর্যোগকালে জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগাতে ঘরের কোথাও কিছু অতিরিক্ত রশি রেখে দেন উপকূলের মানুষেরা। এ বিষয়ে একজন বলছিলেন, ‘প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় কিছু একটা বাঁধার জন্য এই রশি প্রয়োজন হতে পারে। সেজন্য প্রায় ঘরে অতিরিক্ত রশি রাখা হয়। গবাদি পশু রক্ষায়ও তারা বিশেষ উদ্যোগ নেয়। দুর্যোগকালে ঘরের পাশের উঁচু ভিটায় রাখে গবাদিপশু। অনেকে রশিগুলো কেটে রেখে দেয়। যাতে বিপদ হলেও ওরা ছুটতে পারে। অনেকে দুর্যোগ আসার শঙ্কা থাকলে শুকনো খাবার মজুদ রাখে; যাতে দুর্যোগকালে ক্ষুধার ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলে দুর্যোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এইসব দুর্যোগের মধ্যে পড়েই মানুষগুলো নানার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বার বার বিপদে পড়লেও জীবিকার তাগিদে উপকূলের দ্বীপচরে থাকতেই হয় তাদের। নিজের এক টুকরো ভিটে, সামান্য সম্পদই যেন তাদের বাঁচার অবলম্বন। তাই প্রকৃতির সঙ্গে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়; সে কৌশল শিখে নেয়। এক সময় মানুষগুলো এইসব দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় নিজেদের। বাঁচে দুর্যোগের সঙ্গে। এক একটি প্রাকৃতিক বিপদ থেকে তারা শিখে নেয় বেঁচে থাকার এক একটি নতুন কৌশল। ঘূর্ণিঝড় আম্পানও হয়তো উপকূলের সংগ্রামী মানুষদের শিখিয়ে যাবে নতুন কিছু।

এ সম্পর্কিত আরও খবর