মেঘনা উপকূলে ভাঙন আতঙ্ক, ঈদেও ছিল না আনন্দ

, জাতীয়

হাসান মাহমুদ শাকিল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, লক্ষ্মীপুর | 2023-09-01 07:23:23

ঈদ এল, আবার চলেও গেল। কিন্তু আনন্দ ছিল না জেলে পাড়াতে। করোনার ক্রান্তিলগ্নে দেশজুড়ে ঈদের স্বাদ নিরামিষ হলেও নদী উপকূলীয় এলাকায় ছিল নুন বিহীন তরকারির মতো। কারণ ইলিশের শূন্যতাই নুন কেনার সাধ্যই ছিল না উপকূলীয় বাসিন্দাদের।

একদিকে করোনা, অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল তারা। আম্পানে ক্ষতি যাই হয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে তাদের। কিন্তু মেঘনার ভয়াবহতা আর কৃপণতায় এখন দিশেহারা লক্ষ্মীপুরের জেলেরা।

জালে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে, তখন জেলে পল্লীতে উৎসব দেখা দেয়। ঘাটগুলো মাছের মেলায় পরিণত হয়। হাসিখুশিতে দিনকাটে জেলে পল্লীতে। কিন্তু কৃপণ হয়ে গেছে মেঘনা। জাল ফেললেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

নদীতে পড়ে গেছে স্কুল ভবন

এদিকে আম্পান শেষ হয়ে গেলেও শান্ত হয়নি মেঘনা। মেঘনার ভয়াবহ রূপ ধারণে উপকূল জুড়ে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে উপকূল। ঈদের আগের দিন মেঘনায় বিলীন হয়ে গেল কমলনগরের চরফলকন সরকারি বিদ্যালয় ভবনটি। প্রায় ৫ মাস আগে ভবনের অর্ধেক বিলীন হয়ে বাকিটা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু অবশেষে সেটিও বিলীন হয়ে গেলো। এতে চরফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া এলাকা হুমকির মুখে রয়েছে। গেল বছর লুধুয়া এলাকার অর্ধেকেরও বেশি মেঘনা গিলে নিয়েছে।

করোনা নিয়ে বিপর্যস্ত পুরো দেশ। লক্ষ্মীপুরেও দুইশ ছুঁই ছুঁই করোনা আক্রান্ত রোগী। এর থেকে বাঁচতে সীমিত পরিসরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা ছিল। সেই সঙ্গে খোলা ছিল মাছের বাজারও। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস নদীতে নিষেধাজ্ঞা শেষে করোনা ঝুঁকি নিয়ে মে মাসের প্রথম দিন থেকে ইলিশ শিকারে নামে জেলেরা। কিন্তু মেঘনার কৃপণতায় ইলিশের তেমন দেখা মিলছে না। এতে দিশেহারা তারা। ঋণের টাকা এখন তাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। রয়েছে আবার দাদনদার ও আড়তদারদের চাপ। এতো কিছুর মধ্যে কিভাবে তাদের ঈদ আনন্দে কাটতো।

বেসরকারি একাধিক সংস্থার তথ্যমতে- জেলা সদর, রায়পুর, রামগতি ও কমলনগরে মেঘনা নদী সংশ্লিষ্ট প্রায় ৬২ হাজার জেলে রয়েছে। আর সরকারি তথ্যমতে প্রায় ৫২ হাজার জেলে আছে। প্রতিটি নিষেধাজ্ঞায় প্রায় ২৪ হাজার জেলেকে সরকারিভাবে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। বাকি জেলেরা কার্ড থাকা সত্ত্বেও পায় না। এরপরেও এ জেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ জেলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে নদীতে নামে না। তবে ৫ শতাংশ জেলে গোপনে নদীতে যায়। আবার ধরা পড়ে কারাদণ্ড ও জরিমানা গুণতে হয়। হারাতে হয় জাল ও নৌকা। পুরো ক্ষতিই জেলেকে গুনতে হয়।

নদীর পাড়ে ভাঙন

কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে’। তার কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা উপকূলের দিকে তাকালে সেরকমই মনে হয়। শত কষ্টে থাকলেও এই জনপদের দিকে দৃষ্টি পড়ে না কারো। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব আসলে নিজের বিশেষায়িত প্রমাণ করতে নদীর পাড়ে ছুটে যান সেলফিবাজরা। সামান্য সাহায্য করে গায়ের সঙ্গে তকমা লাগান দানবীরের। আবার উদ্দেশ্য পূরণ হতেই ভুলে যান উপকূলের অসহায় মানুষগুলোর কথা।

আম্পানকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ৬ কোটি মানুষকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি শহর, মফস্বল শহরে ঠিক মতো দেওয়া হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিতরণ নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। কারা পেয়েছে, কারা পায়নি এটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাইকে ঝড়ো করলে মনে হবে কেউ পায়নি। আম্পান-করোনার ভয়াবহতা আর মেঘনার কৃপণতায় খুব নাজুক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে উপকূলের অসহায় মানুষগুলো। ঈদ এলেও আনন্দ খুঁজে পায়নি তারা। সবমিলিয়ে দিশেহারা জনপদটি।

মেঘনার পাড়ের খবর জানতে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল লধুয়া এলাকার যুবক ফারুক হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, মেঘনা সব গিলে খাচ্ছে। ঈদের দু’দিন আগেও দাঁড়িয়েছিল চরফলকন স্কুল ভবনটি। পরদিন মেঘনার বুকে ঢলে পড়েছে। খুব কান্না পাচ্ছে, কবে যে পুরো এলাকাটাই হারিয়ে যায় মেঘনার পেটে। শেষ রক্ষা কবে হবে? এই বলেই তার কণ্ঠে কান্নার সুর চলে আসে।

এ সময় মাছ পাচ্ছে না জেলেরা

ঈদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, ঈদ উপকূলের মানুষের জন্য আসেনি। যেখানে প্রতিনিয়ত ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। সেখানে আনন্দ কোথা থেকে আসবে। এছাড়া আম্পানের আটদিন থেকেই মেঘনা উত্তাল হয়ে আছে। প্রতিমুহূর্তে কোন না কোন অংশ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে রক্ষা পেতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর