টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা। চার-পাঁচ কিলোমিটার পর যমুনা সেতু। গাড়ির দীর্ঘজট। এনা পরিবহনে বসে যাত্রী জুয়েল হাসান কতবার যে প্রতিজ্ঞা করলেন ঈদ করতে আর বাড়িতে যাবেন না। তিন বছর বয়সী ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পায়চারি করছেন। আর বিড়বিড় করে বলছেন, জ্যাম! পুরো রাস্তা জ্যাম। ঢাকা থেকে আড়াই ঘণ্টার যাত্রা ২২ ঘণ্টায়ও পার হতে পারলেন না। এ পথ মনে হয় আর শেষ হবে না।
শুধু জুয়েল হাসান নয়, সোমবার (২০ আগস্ট) সন্ধ্যায় যারাই উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তাদের অর্ধেক পথেই কেটে যাচ্ছে ২০-২৫ ঘণ্টা। ঢাকা থেকে যমুনা সেতু পযর্ন্ত পুরো সড়ক জুড়ে অসহনীয় যানজট। কোথাও কোথাও গাড়ি স্টার্ট বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছে।
ঢাকা থেকে যমুনা সেতুর মুখ পর্যন্ত যানজটের কারণে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে যেতে যেখানে ৭/১২ ঘণ্টা লাগে সেখানে অর্ধেক রাস্তা পৌঁছাতে লেগে যাচ্ছে ২০-২৫ ঘণ্টা। যমুনা সেতুর মুখেই যানজটে বসে কাটাতে হচ্ছে পাক্কা ৪-৫ ঘণ্টা। পুরো গরুর ট্রাক, মানুষের ট্রাক ও দুরপাল্লার বাস। ভোগান্তির যানজটে পড়ে-তাদের গন্তব্যস্থল এখনও বহুদুর!
সোমবার ১০টার বাসে রওনা দিয়েছেন সোহেল রানা। যথাসময়ে মহাখালি থেকে বাস পেয়ে মনে করেছিলেন আজকের জার্নিটা স্বস্তির হবে। কিন্তু তাঁর আশায় গুঁড়েবালি। সাভার পার হতেই সকাল, গাজীপুর পার হলেন দুপুরে আর যমুনা সেতু পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার।
সোহেল জানালেন, আর ভালো লাগছে না। এমন কষ্টের জার্নি আর কখনও করি নি। কেন যে এত কষ্ট করে প্রতিবার ঈদে বাড়ি যাই ভেবে পাই না। এখন কষ্ট ছাড়া আর কিছু করার নেই।
ঈদযাত্রার ভয়াবহ দুর্ভোগে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন বয়স্ক মানুষ ও শিশুরা। দীর্ঘযাত্রার এ পথে বাসে বসে ছটফট করছে। কারো কারো পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে।
ঈদযাত্রার ভয়ঙ্কর এ দুর্ভোগে যোগ হয়েছে টয়লেট বিড়ম্বনা। নারী শিশুরা এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। পরিবহনগুলো শিডিউল বিপর্যয়ে পড়ে নির্ধারিত হোটেলে যাত্রা বিরতি দিতে পারছেন না। ফলে এমন একটা হোটেলে থামাচ্ছেন, সেখানে ভিড়ের মধ্যে খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। এতে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।
২০ আগস্ট ৭টার বাসে রওনা দেয় আতাহার। ২১ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় টাঙ্গাইলের একটি হোটেল ভাতের অপেক্ষায় থাকা আতাহারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জার্নি পথে বিধ্বস্ত বিরক্ত আতাহার জানালেন, ১৯ ঘণ্টা পর খাবার খেতে বসেছেন। স্ত্রী এসময়টাতে বাথরুমেও যেতে পারে নি। মন্ত্রী বলেছে এবারের ঈদ যাত্রা স্বস্তির হবে; এটা স্বস্তির! এমন কথা বলা জনগণের সঙ্গে বেঈমানি করার সমান।
রুমানা হাফিজ, তিন মাসের অন্তসত্ত্বা বাসের মধ্যে একবার উঠছেন তো আরেকবার বসছেন। রাস্তা জুড়ে বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। এদিকে ছয় বছর বয়সী মেয়ে সন্তানের বিরক্তি। সব মিলে দু:সহ ঈদ যাত্রা পার করছেন রুমানা।
মঙ্গলবার দিনটা ছিল মাঝেমাঝে ঝিরঝির বৃষ্টি আর পুরো সময় কাঠফাটা রোদের। ফলে বিভৎস কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে ছাদে বসে ঈদ করতে যাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের। সঙ্গে নিয়ে আসা ছাতা খুলে পরিত্রাণ পেতে চেষ্টা করছে তারা। আর যাদের ছাতা নেই, তারা রোদ থেকে বাঁচার জন্য শাড়ির আঁচল, গামছা ব্যবহার করছেন। আর বৃষ্টি হলে ভিজছেন।
যাত্রা পথের সীমাহীন ভোগান্তি, ওত পেতে থাকা সড়কের মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে গ্রামে যাচ্ছেন যারা, বাড়ি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এসব মানুষ হয় প্রিয়জনের মুখ দেখে হয়ত সব কষ্ট ভুলে যাবেন। তবে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বাড়ির পানে ছোটা এসব মানুষ কবে নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ যাত্রা পাবেন, আদৌ পাবেন কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে!