নড়াইল: শিশু রোখসানার যখন স্কুলে বই নিয়ে যাওয়ার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল মাঠে খেলা-ধুলা আর হইহুল্লোড় করে সময় পার করার কথা, ঠিক তখনই বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে তার ঠাঁই হল না। উপার্জনের আসায় অন্যের বাড়িতে কাজ করতে তাকে যেতে হল রাজধানী ঢাকার ওয়ারী এলাকার আছাদুল্লার বাসায়। শর্তছিল রোখসানা শুধু আছাদুল্লাহের সন্তানকে দেখাশোনা করবে। তবে বিধিবাম, সেখানেও ঠাঁই হল না তার। কারণে-অকারণে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার রোখসানার সারা শরীরে যেন রয়েছে হায়েনার হিংস্র থাবার ভয়াল চিহ্ন।
বলছিলাম নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার বাহিরপাড়া গ্রামের দিনমজুর রাসেল শেখের মেয়ে রোখসানার কথা। বর্তমানে রোখসানা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নড়াইল সদর হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
জানা গেছে, দিনমজুর রাসেল শেখের নিজের কোনো জায়গা জমি না থাকায় অন্যের জমিতে ঘর বানিয়ে পাঁচ সদস্য নিয়ে বসবাস করছেন। অন্যের জমি চাষ করে এবং শ্রম বিক্রি করে দুবেলা দু’মুঠো ভাত খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেশী সালেহা বেগম রোখসানাকে ঢাকার ওয়ারীতে ব্যবসায়ী আছাদুল্লাহের বাসায় অন্য কোনো কাজ করা লাগবে না শর্তে একটি শিশুকে দেখাশোনার জন্য নিয়ে যায়। গত ১৭ আগস্ট আছাদুল্লাহের ভাইয়ের সংবাদের ভিত্তিতে অজ্ঞান অবস্থায় রোখসানাকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর ১৮ আগস্ট নড়াইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
এ ঘটনায় লোহাগড়া থানায় ৪ জনকে আসামি করে রোখসানার বাবা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। তবে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
রোখসানার বাবার জিজ্ঞাসা আমার মেয়ের নির্যাতনকারীর বিচার হবে তো?
এদিকে শিশু নির্যাতনের এ দৃশ্য দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
অপরদিকে শিশু রোকসানার ওপর নির্যাতনকারীকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে নড়াইলে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার (২৬ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় নড়াইলের সচেতন নাগরিক ও হিউম্যান ডিফেন্ডার্স ফোরাম (এইচআরডিএফ) নড়াইল জেলা শাখার আয়োজনে আদালত সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য দেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার অ্যাডভোকেট এস এ মতিন, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট পরিতোষ বাগচি, নড়াইল প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকী, নড়াইল সচেতন নাগরিক ও হিউম্যান ডিফেন্ডার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান, নারী নেত্রী আঞ্জুমান আরা বেগম, অ্যাডভোকেট রওশন আরা কবীর লিলি, জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সালমা রহমান কবিতা প্রমুখ।
এ সময় বক্তরা বলেন, নড়াইলে শিশুদের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রায়ই এ ঘটনা ঘটে আসছে। নড়াইলে শিশু ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতনকারীদের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো শাস্তি না হওয়ার কারণে এ ঘটনাগুলো বাড়ছে। অবিলম্বে এ সব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান বক্তরা।
মানববন্ধন শেষে শিশু রোকসানার উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আ.ফ.ম মশিউর রহমান বাবু জানান, শিশু রোখসানাকে দীর্ঘদিন যাবৎ শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তার শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে।
লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রবীর কুমার বিশ্বাস জানান, ৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিদের গ্রেফতার করতে ঢাকায় অবস্থান করছেন। দ্রুতই আসামিদের আইনের আওতায় আনা হবে।