মৌসুমজুড়ে চড়া বাজার, তবুও আম নিয়ে ‘কাড়াকাড়ি’

, জাতীয়

হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-08-31 15:54:56

গাছে মুকুল, গুঁটি থেকে পরিপূর্ণ আম হয়ে ওঠা; পুরো মৌসুমেই ছিল প্রতিকূল আবহাওয়া। যখন বৃষ্টির প্রয়োজন তখন প্রখর খরা। আবার রঙ ও মিষ্টতা আসার জন্য যখন দরকার সূর্যের তাপ, তখন লাগাতর ঝড়-বৃষ্টি!

এ যেন আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্য! যা আগে কখনও দেখেনি আমের রাজ্যখ্যাত রাজশাহীর আমচাষীরা। অনেকটা ‘ভড়কে’ গেছেন ফল গবেষকরাও! আর ‘ভ্যাবাচ্যাকা’ অবস্থায় পড়েছিলেন আমচাষী ও পাইকার ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে মহামারি করোনাভাইরাস আর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আম্পান! সবমিলিয়ে কয়েক স্তরের চিন্তার ভাজ পড়েছিল রাজশাহীর আমচাষী এবং লক্ষাধিক মৌসুমি পাইকার ব্যবসায়ীদের কপালে!

তবে সেই কপালে ভাজ এখন আর নেই! হাত ওঠেনি মাথায়ও! সব ভয়-শঙ্কা কাটিয়ে মৌসুমজুড়ে বাজারে অতি সম্প্রতিকালের মধ্যে সর্বোচ্চ চড়া দাম মিলছে আমের। লকডাউন তুলে নেওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপে আম পরিবহনেও বেগ পোহাতে হয়নি তাদের।

ফলে আমচাষী, মোকাম মালিক এবং বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই করোনাকালেও যেন ঈদ আমেজ! দিন-রাত গাছ থেকে আমপাড়া, বাজারে নেওয়া, মোড়কীকরণ, কুরিয়ার বা ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনে পরিবহনের জন্য বুকিংয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের।

রাজশাহীর পুঠিয়া, বানেশ্বর, বাঘা ও চারঘাটে ঘুরে এবং আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এমন তথ্যই মিলেছে। শুক্রবার (৩ জুলাই) রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বর বাজারে সরেজমিন ঘুরেও দেখা গেছে- বাজারে আম আসা মাত্রই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

বানেশ্বর বাজারে আমের হাট

শেষ সময়ে যারা খিরসাপাত বা হিমসাগর আম নিয়ে বাজারে আসছেন, তাদের গলার সুর বেশ চড়া! মণ প্রতি ৩৬০০ থেকে ৪০০০ টাকার নিচে দাম-দরে নামছে না। অর্থাৎ খিরসাপাত বা হিমসাগরের কেজি এখন ১০০ টাকা! বাজারে মিলবে বড়জোর আর তিন থেকে চারদিন। করোনাকালে জীবন-মৃত্যু নিয়ে যখন ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই, তখন বিখ্যাত খিরসাপাত আম এ মৌসুমে শেষবার খেতে মন চাইলে আপনার হাতে সময় নেই মোটেও!

বাজারে টান পড়েছে ল্যাংড়া আমেরও। মঙ্গলবার (৩০ জুন) অব্দি স্বাভাবিক দাম থাকলেও জুলাইয়ের শুরুতেই চড়া ল্যাংড়ার বাজার দরও। আমের ‘রাজা’ ফজলির জন্য বাজারে জায়গা ছেড়ে দিতেই যেন হুড়হুড় করে ফুরিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু ল্যাংড়া। কিনে খেতে হলে মণ প্রতি গুণতে হবে ৩২০০ থেকে ৩৪০০ টাকা। অর্থাৎ কেজি প্রতি ৮২ থেকে ৮৫ টাকা।

বাজারে এখন সবচেয়ে বেশি মিলছে আম্রপালি। খুব বেশি মিষ্টি জাতের এই আম রাজশাহীর বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ২৮০০ টাকা মণ। অর্থাৎ কেজি প্রতি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা প্রায়। তবে স্বাদ, গন্ধ ও রঙহীন হওয়া এ মৌসুমে স্বাদগুণে এখনও ভালো রেটিং পাচ্ছে আম্রপালি-ই!

প্রশাসনের সময়সীমা অনুযায়ী ফজলি পাড়ার কথা ছিল ১৫ জুন থেকে। কিন্তু ওই যে আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্য! তাই বেঁধে দেওয়া সময়ের ১৮ দিন পরও বাজারে দেখা নেই আমের রাজা ‘ফজলি’র! অল্প-স্বল্প যা বাজারে এসেছে, তাতে এখনও স্বাদ-গন্ধ খুবই কম! অর্থাৎ পরিপক্বতার ঘাটতি। যা এসেছে তা বৃহস্পতিবার (২ জুন) বিক্রি হয়েছে ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা মণ। অর্থাৎ কেজি প্রতি ২৭ থেকে ৩০ টাকা।

সুমিষ্ট আম্রপালির ভেতরের রঙ

এছাড়া রাজশাহীর বাজারে এখন পাবেন লক্ষ্মণভোগ বা লখনা এবং নাবী জাত বা দেরিতে মুকুল আসা গাছের গুঁটি আম। কম মিষ্টি হওয়ায় লক্ষণভোগকে স্থানীয়রা অনেকে ‘ডায়াবেটিক আম’ বলে থাকেন। সেই ডায়াবেটিক আমও বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ। আর নাবী জাতের গুঁটি আম খুব অল্প পরিমাণে বাজারে মিলছে। গুণমান ভেদে সেগুলো গড়ে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।

তবে মৌসুমজুড়ে ভালো দামে বিক্রি হওয়া আমের বাজার এবার এগোচ্ছে যেন ‘চীনের বুলেট’ ট্রেনের গতিতে! তাই যে দরদাম আজ জানাচ্ছি, কাল তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, জানেন না ব্যবসায়ী বা মোকাম মালিকরাও।

বানেশ্বর বাজারে প্রায় ২৩ বছর আমের ব্যবসা করছেন ষাটোর্ধ সলেমান শেখ। তিনি বলেন, ‘ভাবছিলাম- এবার ব্যবসা তো হবেই না, দোকানভাড়া কীভাবে মিটাবো! কিন্তু সবই এখনও পর্যন্ত ঠিকঠাক। গোপালভোগ, খিরসাপাত ভালো দরে বিক্রি হওয়ায় লাভের মুখ দেখেছি। ল্যাংড়া-আম্রপালির বাজারে খুব ভাল। এখন ফজলির বাজার ভালো গেলে করোনার মৌসুমে আর হা-হুতাশ থাকবে না।’

পুঠিয়ার শিলমাড়িয়া গ্রামের আমচাষী রইছ উদ্দিন বলেন, ‘আম বেচা-বিক্রি হবে কিনা তা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তবে কীভাবে কীভাবে বাগান ফাঁকা হয়ে গেল দেখছি! অল্পকিছু আম্রপালি আর ফজলি আছে। বিক্রি হলে আম শেষ! লাভের হিসেব কষতে গেলে আম্পানে যে আম ঝরে পড়েছে, তা ভালো দাম পাওয়ায় পুষিয়ে গেছে। লোকসান গুণতে হচ্ছে না, তাতেই খুশি।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আবহাওয়া তো খারাপ ছিলই। পাশাপাশি আম্পানের আঘাতে এলাকা ভেদে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আম ঝরে গেছে। করোনার কারণে বেচা-বিক্রি নিয়ে চাষিরা শঙ্কায় ছিলেন। তবে সব শঙ্কা উঠে গেছে। চাষি ও বাগান মালিকরা আমের ভালো দাম পেয়ে খুশি।’

বাগান থেকে আম পেড়ে ক্যারেট ভরে সারাদেশে পাঠানো হচ্ছে

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, কৃষি অধিদফতর আগে থেকেই পরিকল্পনা মাফিক পদক্ষেপ নেওয়ায় আমচাষীরা সুফল পেয়েছেন। পাশাপাশি পরিবহনের ক্ষেত্রেও ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ভালো ভূমিকা রেখেছে। যখন ম্যাংগো স্পেশাল চালু করা হলো, তখন অন্যরাও বিভিন্নভাবে আম পরিবহনে কাভার্ডভ্যানসহ বিভিন্ন সার্ভিস নিয়ে এগিয়ে এলো। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগের সমন্বিত ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।’

তবে আমের রাজ্যে সব চাষিরাও আবার ভালো নেই! এখনও শঙ্কায় ভ্রু-কুঁচকে আছেন কয়েকবছর ধরে ইউরোপে আম রফতানি করা বাঘা উপজেলার চাষিরা। তারা ফ্রুটব্যাগে ১০০ মেট্রিকটনেরও বেশি আম উৎপাদন করেছেন। যাতে স্বাভাবিক আম পরিচর্যার চেয়ে কয়েকগুণ খরচও বেশি।

লোকসান কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজতে ব্যস্ত রফতানিকারী আমচাষীরা তাই দিশেহারা। তাদের চোখে-মুখে কেবল প্রশ্ন- ‘কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থা হলো কী?’ কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানেন না কৃষি কর্মকর্তা শামসুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘শুনেছি- সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হচ্ছে। কয়েকটি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে এসেছে। তবে নিশ্চিত কোনো তথ্যই আমার কাছেও নেই।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর