ভাত জোটে না ফুলমুল পাইমো কোটে

, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-26 02:21:21

কাজ বন্ধ থাকায় দুই বেলা ভাতেই জোটে না, ফুলমুল পাইমো কোটে। হামার একন বাঁচি থাকাই ধুনশুন হয়া গেইচে।

সন্তানসম্ভবা মেয়ের পুষ্টির বিষয়ে প্রশ্ন করতেই এমন আক্ষেপ ঝরে নাসিমা বেগমের কণ্ঠে। করোনা তাদের দিন এনে দিন খাওয়া জীবনকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ৭টি বাসায় ধোয়া-মোছার কাজ করতেন। করোনা আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।

জমি-জমা বলতে কিছুই নেই। স্বামী আবেদ আলী একটি বাসায় নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেন। তার চাকরি এখনও বহাল রয়েছে। দু’জনের আয় দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে যেতো। অন্তত ভর্তা-ভাতের অভাবে পড়তে হয়নি খুব একটা। হঠাৎ করোনায় নাসিমা বেগমের জীবনকে চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে।

ঠিক যখন নিজের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তখনই মেয়ের জামাই খুশির সংবাদ দিয়ে গেছেন, তিনি নানি হতে যাচ্ছেন। খুশির সেই সংবাদের সঙ্গে একটি দুঃসংবাদও দিয়ে গেছেন। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় সন্তানসম্ভবা আরফিনাকে বাবা বাসায় রেখে গেছেন জামাই। যাতে তার সেবাযত্নটা সঠিক মতো হয়।

বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করলেও বেশ সচেতন মনে হলো নাসিমা বেগমকে। গর্ভবতী মেয়ের যে কিছু বাড়তি খাবার প্রয়োজন হয় জানেন কি। জবাবে বলেন জানিনে ফির জানিতো। কিন্তু টেকা পাইমো কোনটে। একজনের আয় আর কয়টেকা। তাই দিয়ে চালেই জোটে না।

রূপনগর বস্তিতে আফরিনার মতো আরও অনেক সন্তানসম্ভবা মহিলা রয়েছে। যারা প্রথমবারের মতো মাতৃত্বের স্বাদ নিতে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ দ্বিতীয়-তৃতীয়ও রয়েছেন। এই সময়ে তাদের যে পুষ্টির প্রয়োজন বিষয়টি তাদের সকলের কমবেশি জানা। তবে সকলেই প্রায় অসহায় নিয়তির কাছে পরাজিত। এখন জীবন বাঁচানোর জন্য দু’বেলা ভাতের সংগ্রামে ছুটতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে ভিক্ষুকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। নিজ এলাকায় হাত পাততে না পেরে দূরের মহল্লায় চলে যাচ্ছেন।

মানুষদের মধ্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ

সরকারি ত্রাণ সামগ্রী (চাল-আলু-তেল-লবণ) দেওয়া হলেও সেটিও অপ্রতুল। এই ত্রাণের ক্ষেত্রে ঢাকার এনআইডি কার্ডধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের ভোটার ভাসমান এসব লোক মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বস্তির এসব বাসিন্দাদের কাছে পুষ্টির বিষয়টি সব সময়েই বড়লোকি কারবার হিসেবে পরিচিত। যার ফলে হাজার লোকের ভিড়েও তাদের খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হয় না।

গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই উপেক্ষিত। সে কারণে আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন জরুরি খাদ্য চাল-ডালের পাশপাশি পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের জন্য। এটি করা না গেলে করোনার প্রতিঘাত কয়েক যুগ ধরে বয়ে বেড়াতে হবে বাংলাদেশকে।

বাংলাভিশন’র বার্তা সম্পাদক মোস্তফা কামাল বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, করোনায় বেঁচে যাওয়াদের কী হবে? তারা অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে কিনা- এ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভিটামিনহীন হয়ে বেঁচে থাকার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে? প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক হলেও ভাবনায় আসছে না সেভাবে। সুস্থ-স্বাভাবিক বা নিরোগভাবে বেঁচে থাকতে এমনিতেই প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ভিটামিনযুক্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ। সারা বছর অপুষ্টিতে ভোগেন তারা। তার ওপর এই করোনা দুর্যোগে তারা আরো পুষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। শুধু চাল-ডাল-তেল-আলুর বাইরে আরো কিছু ভাগ্যে জুটছে না এই শ্রেণিটির। মাছ-মাংস-ডিম, শাক-সবজি ও ফলমূলসহ প্রোটিন ও ভিটামিনযুক্ত খাদ্য না পাওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তলানিতে চলে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিদিনের বুলেটিনে করোনার ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। নিম্নবিত্তরা পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে কি? সরকারিভাবে এখনো কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে পুষ্টি জোগানোর? নিম্ন আয়ের মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ায় পুষ্টিকর দূরে থাক স্বাভাবিক খাদ্য জোগাড়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ইত্যাদি খনিজ তাদের পেটে যায় না। অর্থাৎ বেঁচে গেলেও অপুষ্টিতেই থাকছে তারা। অপুষ্টিজনিত কারণে একদিকে যেমন অ্যান্টিবডি তৈরি না হওয়ায় রোগাক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে, অন্যদিকে কোষগুলোর কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

অ্যান্টিবডি তৈরিতে পুষ্টিকর খাবার

করোনায় মৃত্যুহার কমানোর প্রধান উপায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। সেটার জন্য খাদ্য তালিকায় উজ্জ্বল রঙের ফল কমলালেবু, পেঁপে, আঙুর, আম, কিউই, আনার, তরমুজ, বেরি, জলপাই, আনারস এবং পারপেল-লাল পাতাকপি, বিট, ব্রোকলি, গাজর, টমেটো, মিষ্টি আলু ও ক্যাপসিকামসহ উজ্জ্বল রঙের সবজি, ডিম, সবুজ শাক, মুরগির মাংস, কলিজা, দুধ জাতীয় খাবার, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, পেস্তা বাদাম, বাদাম তেল, ভেজিটেবল অয়েল, জলপাইয়ের আচার, আমলকি, লেবুসহ বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, ই, সি সমৃদ্ধ খাবার রাখার কথা বলছেন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। যেখানে চাল-আলু-ডালই জোগাড়ের অবস্থা নেই, সেখানে এই ম্যানু বাতলানো পরিহাসের মতো। ত্রাণের আলু ভর্তা-ভাজি খেতে যে তেল-পেঁয়াজ-মরিচ-লবণ লাগবে তা কেনার টাকাই যাদের হাতে নেই তাদের ফলমূল, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ খাওয়ার কথা বলা মশকরার নামান্তর।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বি. জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, পুষ্টি নিয়ে কাজ হচ্ছে না বিষয়টি এমন নয়। আমরা ত্রাণ বিতরণের সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুধও যুক্ত করছি। পাশাপাশি কিছু এনজিও পুষ্টি নিয়ে কাজ করছে। ইউএনডিপির সহায়তায় এলআইইউপিসি নামের একটি প্রকল্পের আওতায় ৫ হাজার লোককে ফুড প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। জুলাই থেকে তারা আরেকটি প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। এখানে ১ হাজার ৩৫০ গর্ভবতী মাকে দেড়বছর মেয়াদি ফুড প্যাকেজ দেওয়া হবে। মাসের প্যাকেজে থাকবে ৩০টি ডিম, ১ কেজি ডাল ও ১ লিটার তেল। এছাড়া ব্র্যাকসহ আরও কিছু এনজিও কাজ করছে। তবে আরও বেশি আকারে করতে পারলে ভালো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর