‘ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি পানিতে ভাসছি। রাস্তা বা খাল বোঝার কোনো উপায় নাই। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ভেঙে কোনোমতে রাস্তায় গিয়ে উঠলাম। কিন্তু ঘরের জিনিসপত্র উদ্ধার করতে পরলাম না। সব পানিতে ভেসে গেছে।’
মলিন মুখে কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সর্দার পাড়ার ৭০ বছরের আলিমুল মিয়া। তিনি ৩০ বছরেও তিস্তার পানির এমন আক্রোশ দেখেননি। হঠাৎ করে তিস্তার থাবায় সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত আলিমুল মিয়ার মতো অনেকেই।
ওই গ্রামের কৃষক শুকুর আলী বলেন, ‘১৯৯০ সালের পর এবার তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে।’
রোববার (১২ জুলাই) রাত ১২টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫৩ দশমিক ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ অবস্থায় জেলায় ৪০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে সরকারি হিসেবে এর পরিমাণ ২১ হাজার।
এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে হাতীবান্ধা উপজেলায় গড্ডিমারী গ্রামের আরিফা আক্তার নামের ৮ মাসের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে তিস্তা এমন ফুলে ফেঁপে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ রোববার রাতে বিশেষ সতর্কতা জারি করে। লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতেও মাইকিং করা হয়েছে। হাতীবান্ধা-বড়খাতা বাইপাস সড়কে পানির চাপ ঠেকাতে এলাকার লোকজন বালির বস্তা ফেলছে। আদিতমারীতে একটি বালুর বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ফেলা অব্যাহত আছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে সোমবার দুপুর ১২টায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকেল ৫টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তার পর ধরলার পানি অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করছে। সদর উপজেলার মোগলহাটের শিমুলবাড়ি পয়েন্টে সোমবার দুপুরে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে আতংকিত হয়ে পড়ছে লালমনিরহাট শহর ও শহরতলীর লোকজন। ধরলার এমন অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধিতে সদর উপজেলার মোগলহাট ও কুলাঘাট ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
ভারতের গজালডোবা ব্যারেজ থেকে নেমে আসা পানি নিয়ন্ত্রণ করতে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে অবস্থিত দেশের সর্ব বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়ায় লালমনিরহাটের আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম ও সদর উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বানভাসি এসব মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অবিরাম বৃষ্টিতে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের ৭টি ওয়ার্ডের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শুধু এই ইউনিয়নেই ১০ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন জানিয়েছেন।
তিনি জানান, এসব পানিবন্দি পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারিভাবে উপজেলার দুটি ইউনিয়নের পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ৩৫ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, ব্যারাজের উজান ও ভাটিতে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে।