পাইকার না আসা ধরলে ঠ্যায়ে (একবারে) মইরা যামু। ঋণের টাকা কি দিয়া দিমু? পেয়ারা আর কয়দিন গাছে রাখমু। পাঁকলে আবার দাম কম। গাছ থেকে পাড়লে আবার দুই-তিনদিন রাখলে পঁচা যায়। নাই কোনো পেয়ারা মজুদ করার ঠান্ডা ঘর। তাই কম দামেই পেয়ারা বেঁচি— এভাবেই বার্তা২৪.কমকে দুর্দশার কথা জানাচ্ছিলেন ভীমরুলি গ্রামের পরেশ নামে এক পেয়ারা চাষি।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাব পড়েছে বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠি জেলার ভীমরুলি খালে ভাসমান পেয়ারা বিক্রির হাটে। হাটে পেয়ারার ব্যাপক সরবরাহ থাকলেও পাইকার সংকটে বিপাকে পড়ে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পেয়ারা চাষিরা।
স্থানীয় কিছু পাইকারদের আনাগোনা থাকলেও দূরদূরান্ত থেকে পাইকার না আসায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় চাষি, কৃষি বিভাগ ও প্রশাসন।
স্থানীয় চাষি ও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনেক বছর ধরে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীমরুলির খালে বসছে ভাসমান পেয়ারা হাট।
প্রতিবছর ঝালকাঠি সদর উপজেলার কৃত্তিপাশা, ভীমরুলি, শতদাসকাঠি, খাজুরা, মিরাকাঠি, ডুমুরিয়া, জগদিশপুর, খোদ্রপাড়া, পোষন্ডা, হিমানন্দকাঠি, বেতরা, কাপড়কাঠিসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি এলাকার ৫০-৬০টি বাগানে শত শত হেক্টর জমিতে উৎপাদিত কয়েকশ টন পেয়ারা বিক্রি হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পেয়ারার মৌসুমে প্রতিদিন বাগান থেকে পেয়ারা পেড়ে ছোট ছোট নৌকায় করে এই ভাসমান হাটে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন চাষিরা।
এখানকার সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় খালে ছোট ও মাঝারি নৌকা আর ট্রলারে বসেই বিক্রি করছে পেয়ারা। পেয়ারার সরবরাহ তুলনায় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকা থেকে এখনও পাইকার না আসার কারণে পেয়ারা পঁচার শঙ্কায় আছেন এসব চাষিরা।
স্থানীয় কয়েকজন পাইকারের কাছেই জিম্মি হয়ে ঋণের বোঝা মাথা নিয়ে ন্যায্য মূল্য ছাড়াই পেয়ারা বিক্রি করছেন চাষিরা। আরও জানা গেছে, গত বছর এ সময়ে পেয়ারা মণপ্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে পাইকার সংকটে তা কমে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকার কারণে শত শত নৌকা আর ট্রলারের পেয়ারা বাজারজাত করা হলেও সোমবার (১৩ জুলাই) মাত্র চারটি ট্রলার ৩/৪ স্থানীয় পাইকাররা ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা ধরে পেয়ারা ক্রয় করেন।
এছাড়াও দেখা গেছে, এই ভাসমান হাটে পেয়ারার পাশাপাশি হরেক রকমের কচুঁ, কুমড়া, কলা, শাক-সবজিসহ সুপারি, লেবু ও আমড়া পাইকার সংকটে কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
হিমানন্দকাঠির সুবেদ নামে এক পেয়ারা চাষি বার্তা২৪.কমকে জানান, করোনার কারণে অন্যান্য আয়-ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে। মনে করছিলাম পেয়ারা বিক্রি করে একটু ডানে (লাভে) থাকমু। কিন্তু পেয়ারা গাছ থেকে পাইড়া বেঁচতে আনলে দেখি পাইকার নাই। তিন-চার জন পাইকার যা কয় হেই দামেই বেঁচি।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রাসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো: ফজলুল হক বার্তা২৪.কমকে জানান, এ বছর ৮০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে কিন্তু করোনার কারণে দূরদূরান্ত থেকে পাইকার না আসার কারণে বিপাকে পড়েছে পেয়ারা চাষিরা।
এতে করে চাষিরা একদিকে পেয়ারা বিক্রির ন্যায্য মূল্য হারাচ্ছেন আরেক দিকে কোল্ড স্টোরেজ না থাকায় পেয়ারা পঁচে গিয়ে লোকসানের শিকার হচ্ছে। তবুও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পেয়ারা চাষিদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো: জোহর আলী বার্তা২৪.কমকে জানান, করোনা পরিস্থিতিতে ভীমরুলি খালে ভাসমান পেয়ারা হাটে পাইকার সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটময় পরিস্থিতির কিছুটা উত্তরণের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সংযোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনলাইনের মাধ্যমে পেয়ারা বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে পেয়ারা চাষিরা তাদের ব্যাপক লোকসান থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে।
তিনি আরো জানান, স্থানীয় কৃষকরা এই করোনা পরিস্থিতিতে বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য প্রদর্শন করে সারাদেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক বাজার ধরতে পারবেন এবং তাদের ন্যায্যমূল্য পাওয়াও সহজ হবে বলেও আশাবাদী এই জেলা প্রশাসক।