নড়াইল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের অধীনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪১টি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৭টি ঘর নির্মাণের তালিকা করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য এক লাখ টাকা করে মোট ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। তবে বরাদ্দকৃত অর্থের সম্পূর্ণ টাকা ব্যয় করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ টাকা ব্যয়ে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হত তাহলে অসহায়, দুস্থ ও পুনর্বাসিত মানুষদের স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হতো বলে অভিযোগ উঠেছে।
উপকারভোগীরা দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিনামূল্যে পাওয়া ঘরের মেঝেতে তাদের মাটি ভরাট করতে বাধ্য করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা। এ জন্য ধার-দেনা করে গুনতে হয়েছে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। মাথা গোজার একমাত্র গৃহটি যাতে সুন্দর হয় সে জন্য কর্তব্যরত কর্তাদের কথা মতো ঘর নির্মাণকারী শ্রমিকদের নিয়মিত দুই বেলা এমনকি কখনো কখনো তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে উপার্জনে অক্ষম পরিবারদের।
লোহাগড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে ‘যার জমি আছে ঘর নাই, তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ নীতিমালা অনুযায়ী গঠিত কমিটি (পিআইসি) দ্বারা নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও রকিবুল ইসলাম কালু ও রাইজুল নামের দুইজন ঠিকাদার এসব কাজ যেনতেন ভাবে শেষ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার দুস্থ-অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, উপার্জনে অক্ষম, অতি বৃদ্ধ এমনকি পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য নেই এমন ব্যক্তিরা আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। নীতিমালা অনুযায়ী সুবিধাভোগীর থাকতে হবে এক থেকে ১০ শতাংশ জমি। লোহাগড়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প নকশা ও প্রাক্কলন থেকে জানা গেছে, প্রতিটি ঘরের মেঝে ১৫০ মি.মি. বালি দেওয়ার পর ডাবল লেয়ার পলিথিনের উপর ঢালাই দিতে হবে।
তবে সরেজমিনে গিয়ে তার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। প্রতিটি দরজা ও জানালায় রঙ করার কথা উল্লেখ থাকলেও তা করা হয়নি।
উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের উপকারভোগী পতো বিবির নামে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত বছর ৩০ জুনের মধ্যে ওই অর্থবছরের কাজ শেষ করার কথা থকলেও পতো বিবির ঘরের মেঝ আজও পাকা করে দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে পতো বিবি বলেন, ‘ঘর নির্মাণের সময় নির্মাণ শ্রমিকরা আমাকে ঘরের মেঝেতে মাটি দিয়ে ভরাট করতে বলে। আমি বুড়ো (বৃদ্ধ) মানুষ, বয়স্ক ভাতা ও ভিক্ষা করে যে চাল যা পাই তাই দিয়ে কোনো রকম জীবন চালাই। আমার পক্ষে মাটি ভরাট করা সম্ভব না। তখন মিস্ত্রিরা জানায়, যদি মাটি ভরাট না কর তাহলে ঘরের কাজ বন্ধ থাকবে। উপায় না পেয়ে ঋণ করে কিশেন (লেবার) দিয়ে মাটি ভরাট করি। এ কাজে কিশেনদের (লেবারদের) ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু আজও আমার ঘরের মেঝ পাকা করে দেওয়া হয়নি।’
২০১৭-১৮ অর্থ বছরে লোহাগড়ার দিঘলিয়া ইউনিয়নের মৃত ইউছুপ শেখের ছেলে প্রতিবন্ধী রহমত শেখের নামে একই প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ হয়। রহমতের মা দিলারা বেগম বলেন,‘ঘর নির্মাণের ঠিকাদার আমাকে দিয়ে মেঝেতে মাটি ভরাট এবং বাথরুমের গর্ত খুঁড়তে বাধ্য করে। আমি ১০ জন কিশেন (লেবার) দিয়ে মাটি ভরাট ও গর্ত করি। তাতে আমার খরচ হয়েছে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া নির্মাণ শ্রমিকদের তিন বেলা খাবার দিতে হয়েছে। খাবার দিতে না চাইলে টিনের মিস্ত্রিরা চাল ফুটো (ছিদ্র) করে দেওয়ার ভয় দেখালে বাধ্য হয়ে তাদের খেতে দেই। কষ্টের বিষয় আমাদের মতো দুস্থ-অসহায়দের অর্থেও ভাগ বসানো হয়।’
ইতনা ইউনিয়নের লংকারচর গ্রামের উপকারভোগী আমেনা বেগমের নাতী ইসাহাক বলেন, ‘আমেনা বেগমের বাড়ি রাস্তা থেকে একটু দূরে হওয়ায় ঘর নির্মাণের ঠিকাদারের লোকজন কাঠ, টিনসহ অন্যান্য উপকরণ রাস্তার উপর রেখে যায় এবং আমাদের জানায় এসব মাল তোমাদের নিজ খরচে বাড়িতে নিতে হবে। উপায় না দেখে ১ হাজার ২০০ টাকা ভ্যান ভাড়া দিয়ে সেগুলি বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে ৮০০ টাকা খরচ দিয়ে মেঝেতে মাটি দেই। এমনকি ঘর পাকা করতে শ্রমিকদের বালি কম পড়ে। সেই বালিও আমরা ৭০০ টাকা দিয়ে কিনে দিলেই তবে ঘরের কাজ শেষ হয়।’
প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিম উদ্দিন বলেন, ‘সরকার যে টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তা দিয়ে নকশা ও প্রাক্কলন মোতাবেক ঘর তৈরি করা সম্ভব না। যদি কোনো ঘরে অনিয়ম আপনাদের চোখে ধরা পড়ে তবে আমাদের জানাবেন। আমরা বিষয়টি দেখব।’
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প বস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুকুল কুমার মৈত্র বলেন, ‘আমি খোঁজ খবর নিয়েছি সরকারের বরাদ্দকৃত এক লাখ টাকায় ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করা কঠিন। যে সমস্ত ঘরের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে তা দ্রুত সমাপ্ত করা হবে।’
নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমান বলেন,‘এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে যেভাবে তদারকি করার কথা তা করা হয়নি।’