শীতলক্ষ্যায় বালু উত্তোলন, মন্ত্রণালয়ে আবেদনেও মেলেনি প্রতিকার

, জাতীয়

মাহমুদুল হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাজীপুর | 2023-08-31 06:15:19

পূর্বে কাপাসিয়ার সিংহশ্রী, পশ্চিমে শ্রীপুরের বরমী। মাঝখানে দুটি উপজেলাকে বিভক্ত করে রেখেছে শীতলক্ষ্যা নদী। কাপাসিয়ার অংশটিতে পাড় ঘেঁষে বহু স্থাপনা থাকলেও শ্রীপুরের অংশে উল্টো চিত্র। তবে শীতলক্ষ্যার নজর কাপাসিয়ার দিকেই বেশি। পাড় ভেঙে পূর্বে বেড়েই চলেছে নদীর সীমানা। ইতোমধ্যে বহু ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি গিলে অনেককে সর্বশান্ত করেছে শীতলক্ষ্যা। ভাঙনের কবল থেকে সম্পত্তি রক্ষায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও প্রতিকার পায়নি এলাকাবাসী।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর কৃষি জমি কমে বাড়ছে নদীর আয়তন। ২০১৫ সালের ২৫ অগাস্ট নদীর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি। প্রতিবছরই নির্দিষ্ট সীমানার পাড় ২০০ হাত করে ভেঙে পড়ছে নদীতে। এর জন্য ঝুঁকিতে রয়েছে মসজিদ, মাদরাসা, বাজারসহ অসংখ্য স্থাপনা।

চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন

সরেজমিনে দেখা গেছে, কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া ও কুড়িয়াদী গ্রাম নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষে অবস্থিত। পাশেই সিংহশ্রী-বরমী আঞ্চলিক সড়কের বরমা সেতু। ঘুরেফিরে তালুকদার বাড়ি ঘাট থেকে সিংহশ্রী বাজার ঘাট হয়ে দাস বাড়ি পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সীমানায়ই ভাঙন সবচেয়ে বেশি। নদীর তীরবর্তী এই সীমানা ঘেঁষে রয়েছে সিংহশ্রী দারুল উলুম মাদরাসা, সিংহশ্রী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সিংহশ্রী বাজার, সিংহশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়, সোনালী ব্যাংক, সিংহশ্রী পল্লী বিদ্যুৎ অফিস, পুলিশ ব্যারাক, রাইস মিলসহ অসংখ্য স্থাপনা।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ২০-২৫ বছরে সিংহশ্রী দাস বাড়ি থেকে উত্তর দিকে কুড়িয়াদী তালুকদার বাড়ি ঘাট পর্যন্ত পূর্বপাশের দুই কিলোমিটার তিরের প্রায় ৩০০ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এই সীমানার মধ্যেই নদীর পাড় ঘেঁষে সিংহশ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক এক সভাপতির মালিকাধীন ‘মেসার্স সৈকত ট্রেডার্স’ ও তার এক স্বজনের মালিকাধীন ‘মেসার্স কাদির মেম্বার এন্টারপ্রাইজ’ নামক দুটি অবৈধ বালুরমহাল রয়েছে। মোটা পাইপ দিয়ে নদীর সঙ্গে দুটি বালুমহালের সংযোগ রয়েছে। রাতে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে সংযোগ পাইপের মধ্যমে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

মোটা পাইপ দিয়ে নদীর সঙ্গে দুটি বালুমহালের সংযোগ রয়েছে

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এর ৬২ নম্বর বিধান অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা এবং আবাসিক এলাকা হতে সর্বনিম্ন ১ কিলোমিটারের মধ্যে বালুমহাল স্থাপন করা নিষিদ্ধ। একই আইনে ইজারা ব্যতীত বালুমহাল হতে বালু বা মাটি উত্তোলন, পরিবহন, বিপণন ও সরবরাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা বার্তা২৪.কমকে জানায়, নদীর তীর ঘেঁষে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। আরেকটি কারণ হলো বর্ষার পানি গড়িয়ে নামার জায়গা নেই। অতিবৃষ্টি হলে পানি তীর গড়িয়ে সরাসরি নদীতে পড়ে। যার ফলে প্রথমে তীরবর্তী অংশে বড় ফাটল ধরে পরে তা পর্যায়ক্রমে ভেঙে পড়ে।


তারা আরও জানায়, বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। এসব নিয়ে কথা বললে এলাকা ছাড়তে হবে। তারা উদাহরণ টেনে জানায়, বছর দেড়েক আগে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বালুর গদি পর্যবেক্ষণে এসে অপমান, অপদস্ত হয়েছেন। ইউএনও’র কাছে দুই মালিক নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি অস্বীকার করে অন্য স্থান থেকে বালু ক্রয়ের রশিদ দেখিয়েছেন।


নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ৭ বছর আগে মেসার্স সৈকত ট্রেডার্স স্থাপন করেছেন সিংহশ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম কাঁইয়া। সার্বিক বিষয়ে তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙলেও, কখনোই নদী থেকে বালু উত্তোলন করিনি। টোক অঞ্চল থেকে বালু কিনে আনি। ১০ বছর আগে এখান থেকে বালু উত্তোলন হতো।

নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি

বালু মহাল আইনটি তিনি জানেন না দাবি করে বলেন, এই আইন বলবৎ থাকলে আমি বালুর গদি অন্যত্র সরিয়ে নেব। আমি তো আইনের ঊর্ধ্বে না। সব বালুর গদি নদীর পাড়ে। এ জন্য আমারটাও নদীর পাড়ে। সিংহশ্রী ক্যাম্পের পাশের বালুর গদিটি নদীর পাড় ঘেঁষে অবস্থিত। সেটি আমার গদি চালুর ৪-৫ বছর আগে থেকে চলছে। সেখানে পাড় ভেঙে নদীতে পড়ছে। আমার গদি নদী থেকে প্রায় ৮০০ ফুট উপরে।


তিনি আরও বলেন, বালু অন্য জায়গা থেকে কিনে এনে নদীতে আনলোড মেশিন বসিয়ে পাইপ দিয়ে গদিতে বালু স্থানান্তর করা হয়। কাপাসিয়া উপজেলা সদরে ও এর আশে পাশে প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ সিফটি বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সেখানে কিছু করে না। আমরা অল্প-সল্প বালু উত্তোলন করি। যেগুলো সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রশাসনের নাগের ডগায় থাকা বালু মহালগুলো বন্ধ হলে আমারটাও বন্ধ করে দিব।


তিনি অভিযোগ করে বলেন, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সবচেয়ে বেশি বালু উত্তোলন হয় গফরগাঁও এবং শ্রীপুরের বরমী অঞ্চলে। ওই অঞ্চলটিতে নদী থেকে বছরে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করা হয়। কাপাসিয়ার প্রশাসন কিছু দিন পর পর বালু উত্তোলনের ড্রেজার আটক করলে সাময়িক সময়ের জন্য বালু উত্তোলন বন্ধ থাকে। কিন্তু তিন দিন না যে যেতেই অদৃশ্য কোন শক্তির বলে সেগুলো পুনরায় চালু হয়।

তিনি আরও বলেন, স্থায়ীভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হলে আমাদের এলাকার অনেক বাড়ি-ঘর ভাঙন ও নদী ভাঙন কমতো। নদী ভাঙন রোধে ও এলাকার শান্তির স্বার্থে প্রয়োজনে আমি বালুর ব্যবসা বন্ধ করে দিব। কিন্তু আমি ব্যবসা বন্ধ করলেই যে- বালু উত্তোলন বন্ধ হবে এটার কি নিশ্চয়তা আছে?

ইউএনও সঙ্গে বাকবিতণ্ডার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউএনও সঙ্গে বাকবিতণ্ডার জেরেই আমার অধঃপতন হয়েছে।

রাতের অন্ধকারে চলে বালু উত্তোলন

আর নদীর তিরে মেসার্স কাদির মেম্বার এন্টারপ্রাইজ নামক বালুর গদি স্থাপন করেছেন এম. মাহবুব আলী। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি বালু উত্তোলন করি না। ছয় মাস ধরে আমার এখানে কোনও ড্রেজার নেই। আর বালু বিক্রি তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। আর বালু গদির জমিটুকুও আমাদের। এটি ভাঙনের কবলে পড়ার আমরাই মূলত বাঁধ নির্মাণের আবেদন করেছি।

তিনি বালু গদির বয়স ২ বছর দাবি করলেও শফিকুল ইসলাম কাঁইয়া জানিয়েছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে এই বালুর গদি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার নিজের জায়গাই ভেঙে নদীতে পড়ছে। এটি ফেরানোর চেষ্টা করছি। বালু মহাল আইনটি তিনি জানতেন না জানিয়ে বলেন, আর বালু উত্তোলন করবো না। এই ব্যবসাই ছেড়ে দিচ্ছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি প্রতিবেদক ও স্থানীয় বাসিন্দা মোক্তার হোসেন তালুকদার বার্তা২৪.কমকে জানান, তার বাবা ডা. আব্দুস সামাদ তালুকদার নদীর ভাঙন প্রতিরোধ ও কৃষিজমি রক্ষায় মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছিলেন। সেটি গাজীপুর-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মো. রহমত আলীর সুপারিশে তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেও ৫ বছরে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

তিনি আরও বলেন, শৈশবে যেখানে বল খেলতাম, সেটি এখন নদী। শুধু নদীই নয়- এই অংশটুকু এখন নদীর মাঝামাঝি। নদী ভাঙন রোধে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পাড়ে সিসি ব্লক করলে সহজেই নদী ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মোটা পাইপ দিয়ে নদীর সঙ্গে দুটি বালুমহালের সংযোগ রয়েছে

ভিটিপাড়া গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মফিজ উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে জানান, তার এলাকার শুক্কুর, মোন্তাজ, আলমাছ, তাজউদ্দীন ও রেহান উদ্দীনসহ বহু লোক নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে এলাকা ছেড়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. ইসমত আরা বার্তা২৪.কমকে বলেন, আগেও এখানে অভিযান চালানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই আবারও অভিযান চালানো হবে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড নরসিংদীর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বার্তা২৪.কমকে বলেন, এলাকাবাসীর আবেদনের পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধির একটি সরকারি চাহিদাপত্র (ডিও লেটার) পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর দিলে আমরা একটি কারগরি কমিটি গঠন করবো। তারপর কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। ভাঙন কবল জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে সিসি ব্লক দ্বারা প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সেটি ৩০ বছরের মতো স্থায়ী হয়।

এলাকাবাসীর আবেদন ও স্থানীয় জনপ্রতিনির সুপারিশের পরও ৫ বছরেও প্রকল্প চালু না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের আবেদন। আর ২০১৮ সালে আমি এখানে যোগদান করেছি। বিষয়টি এতদিন আমার নজরে আসেনি।

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, আবেদনটি অনেকদিন আগের। নতুন করে বর্তমান এমপির সুপারিশে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর আবেদন করলে কাজটি দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। একটি কাজ করতে হলে প্রকল্পের আওতায় করতে হয়। স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজের যে ব্যয়, সেটি প্রকল্প ছাড়া কখনও করা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক সারা বাংলাদেশে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রতিরক্ষামূলক কাজ করা হবে। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এমপিদের হালনাগাদ ডিও লেটারের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর