বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে কারা ছিল? আমরা তো কেবল সরকার গঠন করেছি। এটা কোনোদিনই যুক্তিযুক্ত না, যে আমরা সরকার গঠন করেই এমন একটা ঘটনা ঘটাবো, দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবো। কাজেই যারা তখন ক্ষমতায় আসতে পারে নাই তারাই এটা করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা বলার ভালো একটা আর্ট আছে।
রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে সাহার খাতুন ও ইসরাফিল আলমের ওপর আনিত শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ নেতা একথা বলেন।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন সাহারা খাতুন। তার সাহসী ভূমিকা দেখেছি বিডিআর বিদ্রোহের সময়। আমরা সরকার গঠনের মাত্র ৫২ দিনের মধ্যে বিডিআরের এ ঘটনা ঘটল। বিডিআরের ওই ঘটনায় যে সেনা অফিসাররা মারা যায় তাদের মধ্যে ৩৩ জন আওয়ামী লীগ পরিবারের। এমনকি বিডিআর ডিজি এই পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য লুৎফর হাই সাচ্চুর আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। দেখা গেছে আমাদের আওয়ামী পরিবারের এমনকি আব্দুল মালেক উকিল সাহেবের নাতি অনেকেই সেখানে মৃত্যুবরণ করে। সেসময় ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমাদের চেষ্টা ছিল এটাকে থামানো। আমাদের যারা অফিসার আছে তাদের রক্ষা করা তাদের পরিবারগুলো রক্ষা করা। আমরা যখন সেখানে সেনাবাহিনী নিয়োগ করলাম সেনাবাহিনী নামার সাথে সাথে তাদের গুলিতে কয়েকজন সেনা সদস্য মারা গেল।
তিনি বলেন, বিডিআরের ঘটনাটি ছিল একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। আগের দিন গেলাম একটা ভালো পরিবেশ, পরের দিন সেখানে এধরনের একটা ঘটনা ঘটল। এর পেছনে কারা আছে? আমরা তো কেবল সরকার গঠন করেছি। এটা কোনো দিনই যুক্তিযুক্ত না যে আমরা সরকার গঠন করেই এমন একটা ঘটনা ঘটাবো, দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। কাজেই যারা তখন ক্ষমতায় আসতে পারে নাই তারাই তখন তাদের পেছনে ছিল এবং তাদের সঙ্গে ওই ১/১১ যারা সৃষ্টি করেছিল তাদের ধারণা ছিল নির্বাচনটা একটা আনপার্লামেন্ট হবে কিন্তু যখন দেখল আওয়ামী লীগ মেজরিটি নিয়ে চলে আসল তখন সবকিছু নস্যাৎ করবার অপচেষ্টা যাদের ভেতর ছিল তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একদিন না একদিন এর সত্যতা বের হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা বলার ভালো একটা আর্ট আছে। যেমন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তাদের দলের লোক বললো আমি নিজেই নাকি গ্রেনেড নিয়ে নিজেই গ্রেনেড মেরেছি এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে ফেলল। ঠিক বিডিআরের ঘটনা যখন ঘটল তখন তারা ওইভাবেই অপপ্রচার শুরু করল। কিন্তু এটা কোনদিনই কেউ এর যুক্তি খুঁজে পাবে না। সাহারা আপাকে দেখেছি সাহসে ভর করে সেখানে গেছে। বিডিআরদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বলেছে, রাতের বেলায় অনেক সাহস করে সেখানে গিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলেন এবং তারা করেন। সেদিন অনেক আর্মি পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। উদ্ধার করে আনতে গিয়ে জীবনের ওপর হুমকি বয়ে এসেছে। আমি তখন যমুনায় থাকি তখন বলল নেত্রী কোনো মতো জীবনটা নিয়ে বেঁচে এসেছি। তার ওপরেও হামলা করতে গিয়েছিল ওরা। এই অবস্থায় দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন সাহারা আপা।
সাহারা খাতুনের কর্মদক্ষতা নিয়ে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সততার সাথে তিনি কাজ করেছিলেন, যার জন্য বিএনপির আমলে বাংলা ভাই সৃষ্টি, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি এক সাথে ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা এরকম যেখানে অরাজকতা। তারপর আসল ১/১১ সে সময় আর একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এই অবস্থার মধ্যে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিয়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিয়ে আসেন। মানুষের জীবন যাত্রাটাকে স্বাভাবিক করা এবং মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো কঠিন সময়ে দায়িত্ব পালন করে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাহারা আপা। তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, তার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তিনি সব কিছু নেতা-কর্মীদের বিলিয়ে দিয়েছেন। সারাক্ষণ দেশের জন্যই কাজ করেছেন। অত্যন্ত সাহসী একজন মানুষ এবং আমাদের সংগঠনের প্রতি নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক। তার সঙ্গে আমার ছাত্রজীবন থেকেই পরিচয় ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসাবে।
সাহারা খাতুনের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৬ দফার আন্দোলনের সময় এবং ৭০ এর নির্বাচনের সময় সাবেক মন্ত্রী বদরুন্নেছা আহমেদ তারই নেত্রীত্বে তিনি আমাদের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতেন নির্বাচনী প্রচার করার জন্য। সে সময় ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট, একজনের একটা ভোট এবং ভোট গণনার পদ্ধতি শেখানো হতো। সেখানে সাহারা আপা এবং প্রয়াত আইভী রহমানসহ ৭০ এর নির্বাচনে জাতির পিতা যে আসনে প্রার্থী ছিলেন সেখানে আমরা এক সঙ্গে কাজ করতাম। এরপর ১৯৮১ সালে যখন আমি ফিরে আসি, ফিরে আসার পর থেকে সাহারা আপাকে সব সময় পাশে পেয়েছি। যারা সব সময় আমার পাশে ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। একে একে সবই চলে যাচ্ছে এটাই হচ্ছে দুঃখ।
তিনি বলেন, প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সাহারা খাতুন ভূমিকা রাখতেন, কোনো ভয়ভীতি তার ছিল না। তার ওপর যে অত্যাচার জুলুম হয়েছে এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখনও তার ওপর লাঠির বারি, অত্যাচার নির্যাতন এমনকি পিটিয়ে ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে পা ভেঙে। খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় আসল তখনও তার ওপর সীমাহীন অত্যাচার। একদিকে পুলিশ বাহিনী আরেক দিকে ছাত্রদলের ক্যাডার বাহিনী। কারণ এটা তো তিনি নিজেই বলতেন ছাত্রদল দিয়েই নাকি আওয়ামী লীগকে সোজা করে দেবেন।
আইনজীবী হিসেবে ২০০৭ সালে যখন আমাকে গ্রেফতার করে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আমার বিরুদ্ধে ১২টা মামলা দেওয়া হয়, আর তত্ত্ববধায়ক সরকারের আসার পর আরও ৫-৬টা মামলা দেওয়া হয়। তাদের একটা প্রচেষ্টা ছিল যতদ্রুত মামলাগুলো করে একটা শাস্তি দিয়ে দেবে। বলতে গেলে একদিন পর পর আমাকে কোর্টে হাজির করত। এই মামলাগুলো সাহারা আপা সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকতেন। তার সাহসী ভূমিকা দেখেছি।
আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসরাফিল আলম এতো অল্প বয়সে চলে যাবে বুঝতেই পারি নাই। তার করোনা হয়েছিল আবার তা ভালো হয়েছিল কিন্তু আসলে তার কিডনির সমস্যা ছিল। সে কিছু মানেনি। যখন সে একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি গেল তারপর চলে গেল এলাকায় আবার অসুস্থ হলেন আর ফিরে আসল না। আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা-কর্মী হারিয়েছি করোনায়। কারণ তারা রিলিফ দিতে গেছে বন্যার সময় ত্রাণ দিতে গিয়েছে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে। ঠিক ইসরাফিলের ব্যাপারেও তাই। অত্যন্ত মেধাবী ছিল আমার খুব ইচ্ছে ছিল ভবিষ্যতে সে একজন ভাল পার্লামেন্টারিয়ান হবে। এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো পজিশনে সে যেতে পারত কিন্তু সেই সুযোগটা আর হল না। আমরা ভবিষ্যতের একজন ভালো পার্লামেন্টারিয়ান হারালাম।