রাঙ্গাকে সংসদে এসে ক্ষমা চাইতে হবে

, সংসদ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা, জাতীয় সংসদ ভবন থেকে | 2023-09-01 18:42:40

শহীদ নূর হোসেন নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করায় বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাকে সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা। ক্ষমা না চাইলে তাকে কেউ ক্ষমা করবে না বলেও জানান তারা।

মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চম অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে নূর হোসেনকে নিয়ে রাঙ্গার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার বিষয়টি তুলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী।

এরপর আলোচনায় অংশ নেন, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, নজিবুল বশর মাইজ ভান্ডারী। এসময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ছিলেন।

এরপর তাদের বক্তব্যের জবাবে জাতীয় পার্টির দলীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এটা রাঙ্গার ব্যক্তিগত বক্তব্য। এটা জাতীয় পার্টি ওন করে না।’

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান আমির হোসেন আমু প্রবাদ দিয়ে বলেন, বাংলায় একটা কথা আছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। মশিউর রহমান রাঙ্গা এরশাদ সাহেবের কুকীর্তি এবং স্বৈরাচারীকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত করে কতগুলো অবান্তর কথার অবতারণা করেছেন। আজকে যারা ফেনসিডিলে আসক্ত তারাই ফেনসিডিলের স্বপ্ন দেখে। নূর হোসেনকে যখন হত্যা করা হয় তখন এই দেশে ফেনসিডিল শব্দটা কেউ জানতো না। নূর হোসেন যখন হত্যা হয় তখন ইয়াবা শব্দটা এই দেশের কেউ জানতো না। আজকে যারা এটার আবিষ্কারক তারাই এটার সঙ্গে একটা মিশ্রণ দেখাবার চিন্তা করছে।

তিনি বলেন, শুধু নূর হোসেন না সেলিম, দেলওয়ারকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এমন পৈশাচিকভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিন নূর হোসেন শেখ হাসিনার পায়ে সালাম দিয়ে অল্প কিছু দূর যাওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়। সেই গুলি হয়তো শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে করা হয়েছিলো। তার কারণ এর একটু পরে যখন শেখ হাসিনার গাড়ি প্রেসক্লাবের সামনে যায় তখন সেই গাড়ি ক্রেন দিয়ে তোলা হয়। তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। আজকে যে ভোট ডাকাতির কথা বলা হয়। এই মিডিয়া ক্যুর সৃষ্টিকর্তা এইচ এম এরশাদ। এটা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে।

তিনি আরও বলেন, সেই কথা বলতে গিয়ে রাঙ্গা জাতির জনককে নিয়ে আসা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আসা। এতবড় ধৃষ্টতা তিনি দেখাতে পারেন না। এরশাদের মৃত্যুর পর বলেছিলাম দোষে গুণে মানুষ। আমি নিজে ভুক্তভোগী। শেখ হাসিনাসহ আমাদের ৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। আমাকে টর্চার করা হয়েছিল এই হচ্ছে এরশাদের রাজত্ব। এরকম বহু ঘটনা আছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে সব কিছু করেছে। তাদেরকে জনগণ আখ্যায়িত করেছে স্বৈরাচার হিসেবে আওয়ামী লীগ নয়, কোনো ব্যক্তি নয়, কোন দল নয় সারা দেশের মানুষ তাদের স্বৈরাচার হিসেবেই আখ্যায়িত করেছে। এধরণের যারা বক্তব্য দেন তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রাঙ্গার অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংসদ সদস্য রাঙ্গা এমন একটা বক্তব্য দিয়েছেন যেটা মানুষের মনে ব্যথা দিয়েছে। যে নূর হোসেন বুকে লেখা ছিল স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তিপাক। তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আমি তখন কারাগারে বন্দী। সেদিন আমাদের আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে এরশাদের শাসনামলের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়ায়। আমি অবাক হলাম। মশিউর রহমান রাঙ্গা তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বলেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলেছেন। সকলের বিরুদ্ধে তিনি বলেছেন। অথচ রাঙ্গা ভুলে গেছেন তার নেতা এরশাদ নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দু:খ প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি সংসদে বক্তৃতা করে ওই ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ করেছিলেন। গতকাল নূর হোসেনের মা সংবাদ সম্মেলন করে দু:খ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, তাকে (নূর হোসেনকে) বলেছে নেশাখোর, তাকে বলা হয়েছে ফেনসিডিলখোর, ইয়াবাখোর তাকে বিভিন্নভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে রাঙ্গা বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই বক্তৃতার জন্য ঘৃণা প্রকাশ করছি। আসলে মূলত দীর্ঘদিন পর এই বক্তব্য দিয়ে সারাদেশে ব্যাপকভাবে স্বৈরাচার কথাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার মনে হয় সংসদে দাঁড়িয়ে রাঙ্গার ক্ষমা চাওয়া উচিত জাতির কাছে। আমার মনে হয় জাতীয় পার্টির অন্যান্যরা বিশ্বাস করেন না। রাজনৈতিক দলের মত পথের ভিন্নতা থাকে। আমরা এটাকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করি এবং স্বৈরাচার বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করি। তারা তাদের ভাষায় অন্য দিবস পালন করে।

সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, তিনি (রাঙ্গা) আমাদের নির্বাচনী ঐক্য সম্পর্কে বলেছেন। সেই ঐক্যের কারণেই তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ঐক্য না হলে তিনি বিজয়ী হতেন কি না সেটা বলতে চাই না। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তার ভাষায় খারাপ কথা বলেছেন। খারাপ বক্তৃতা করেছেন। তার দলের কেউ দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে ক্লিয়ার করবেন। একটা কুৎসিত বক্তৃতা দিয়েছেন। একজন সুস্থ মানুষ, তিনি যদি স্বাভাবিক থাকেন স্বাভাবিক অবস্থায় এ ধরণের বক্তৃতা দিতে পারে না। তার এখানে দু:খ প্রকাশ ও জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, আমার মনে হয় কোনো সুস্থ লোক এই ধরণের কথা বলতে পারে না। নূর হোসেন যুবলীগের একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন ত্যাগী কর্মী ছিলেন। আমি তখন যুবলীগের চেয়ারম্যান। সে সময় নিজের বুকে লিখে দিয়েছে স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক। একটা লোক মারা গেছে সে গণতন্ত্রের জন্য মারা গেছে জীবন উৎসর্গ করেছে। কোন বিবেকবান লোক এই ধরনের কথা বলে। শুধু তাকে কথা বলে নাই। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি করতে হলে একটু চিন্তা করা দরকার। সংসদ নেত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। বঙ্গবন্ধু নাকি স্বৈরাচার। গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন কষ্ট করেছেন। গণতন্ত্রকে তৃণমূলে পৌছে দেওয়ার জন্য বাকশাল করেছে।

তিনি বলেন, এরশাদ সাহেব তো পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে নর্থ বেঙ্গলে বসে ২৫শে মার্চ রাতে তাদের পক্ষে কাজ করেছে। এটা বইতে আছে। এসব কথা বলতে চাই না। অতীত অতীতই থাক। কিন্তু যে কথা বলে জাতিকে, গণতন্ত্রকে, শেখ হাসিনাকে ও নূর হোসেনের বিদেহী আত্মার উপর যে আঘাত করেছে। এজন্য তার ক্ষমা চাইলে হবে না। রাঙ্গা তো ঐক্যজোট সরকারের একজন মন্ত্রীও ছিলেন। সে একথা বলে কিভাবে। ওনি যদি এতই বিল্পবী হয়ে থাকেন তো মন্ত্রীসভা থেকে চলে যেতেন। এসব কথা কোন সুস্থ লোক বলতে পারে না। জাতীয় পার্টি একটা ক্লারিফিকেশন দেবে। এটা সত্যিই দু:খজনক গণতন্ত্রের জন্য, রাজনীতির জন্য । ক্ষমা তার চাইতেই হবে। তা নাহলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ক্ষত থেকে যাবে।

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, আমারও দুর্ভাগ্য-সৌভাগ্য হোক সেদিন নূর হোসেন যে মিছিলে জীবন দিয়েছিল। স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক। আত্মহুতি দেওয়া। গুলি করার পর নূর হোসেন আজকের সংসদ নেতার সাথে কথাও বলেছিলেন। একটা কথা আছে রতনে রতন চেনে বাকিটা বললাম না। রতনে রতন চেনে..রাঙ্গা সাহেব ঠিকই শহীদ নূর হোসেনকে যে নূর হোসেনকে সামনে নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। শত শত মুজিব প্রেমিকের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের এই সংসদ হয়েছে। আমি মনে করি রাঙ্গা সাহেব সংসদকেই অবমাননা করেছেন। স্বৈরাচারের পতন না হলে আজকে রাঙ্গা সাহেবও এখানে এসে বসতে পারত না। মশিউর রহমান রাঙ্গা যে বক্তব্য দিয়েছেন সংসদ নেত্রী, বঙ্গবন্ধু এবং নূর হোসেন সম্পর্কে এই কথাগুলো বলে স্বৈরাচারের যে চরিত্র পরিবর্তন হয় না। রাঙ্গা সাহেব তাই কিন্তু প্রমাণ করেছেন তিনি সত্যিকারের স্বৈরাচারীর অনুসারী ছিলেন। গণবিরোধী ছিলেন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। একটি সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়ে রাজনীতির নামে বিরাজনীতি চালানোর প্রচেষ্টা চলছে সেটাকে তিনি সমর্থন সহযোগিতা করেছেন। এই সংসদে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডরী বলেন, রাঙ্গা সাহেব যে কথাগুলো বলেছেন। এটা ‍নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে এই সংসদের বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক সকল ধারার বিরুদ্ধে। তিনি অবস্থান নিয়েছেন। শুনেছি এই বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন, প্রত্যাহার করে লাভ নেই, ওনার ক্ষমা চাইতে হবে। নইলে আমরা অপমানবোধ করছি, না হলে আমরা ক্ষমা করব না। এটা একটা খারাপ নজির। জাতীয় পার্টি যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেন তাহলে আস্থা কুড়ে নিক্ষেপ হবেন।

এরপর তাদের বক্তব্যের জবাবে জাতীয় পার্টির দলীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এটা রাঙ্গার ব্যক্তিগত বক্তব্য। এটা জাতীয় পার্টি ওন করে না।’

তিনি বলেন, আমার নেতা এইচ এম এরশাদ। মশিউর রহমান রাঙ্গা তিনি তার বক্তব্য দিয়েছেন এই বক্তব্যটা জাতীয় পার্টি দলীয়ভাবে ওন করে না। এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত একটা বক্তব্য। এই বক্তব্য তিনি কেন দিয়েছেন। আজকে মশিউর রহমান রাঙ্গা সংসদের সদস্য তিনি সংসদে এসে ক্লিয়ার করবেন। শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে জাতীয় পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি এরশাদ ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি নিজে দু:খপ্রকাশ করেছেন। এটাই ছিল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এর বাইরে আমাদের দলের কেউ যদি কিছু বলেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর