গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রস্তাব সংসদে গৃহীত

, সংসদ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা, জাতীয় সংসদ ভবন থেকে | 2023-09-01 10:08:23

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্বের সংকট, উপর্যুপরি দুর্যোগের ভয়াবহ আঘাত, জীব-বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি এবং সম্পদের অমিতাচারী ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে আনীত ‘গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা’র সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

বুধবার (১৩ নভেম্বর) রাতে সংসদ অধিবেশনে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ (১) বিধি অনুসারে সরকারি দলের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এ সাধারণ প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে আলোচনা শেষে কণ্ঠভোটে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। জলবায়ু নিয়ে বাংলাদেশের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশের সংসদ যারা গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলো।

প্রস্তাবে বলা হয় ‘জরুরি ভিত্তিতে দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং উচ্চতর লক্ষ্য সামনে রেখে এখনই সক্রিয় হতে হবে বৈশ্বিক গোষ্ঠীকে; এতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো এমিশনসে পৌঁছানো, তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা এবং দ্রুততম সময়ে স্বল্প কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তর নিশ্চিত করা। এটি প্রতিষ্ঠিত যে চলমান সংকটে সর্বনিম্ন মাত্রার অবদান রাখার সত্ত্বেও সর্বোচ্চ ক্ষতি এবং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশ ও ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র/ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সকল প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ হয়নি/ গ্রহজনতি ন্যায় বিচার এবং ক্লাইমেট ইক্যুইটির দাবি, ঝুঁকির মধ্যে থেকে এই দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে, যাতে তারা তাদের কাঙ্খিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। এসব বহুমাত্রিক সংকট মোকাবেলায় বিশ্বের সকল পার্লামেন্ট ও সরকার, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক দ্রুত কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হউক এবং সকল অংশীজনের সমন্বয়ে অভিন্নরূপে আমাদের বাসযোগ্য একমাত্র গ্রহটির সুরক্ষা ও হেফাজতের লক্ষে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক।’

আনীত সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই সংকটের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও এর শিকার হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের ফলে আমাদের মতো দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে পড়েছে। তাই ক্ষতির শিকার হতে যাওয়া সব দেশকে একজোট হয়ে সংকট সৃষ্টিকারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। সারাবিশ্বের জন্য গৃহীত প্রস্তাবটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

উত্থাপিত সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বিদ্যুৎ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সরকারি দলের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, কাজী নাবিল আহমেদ, নজরুল ইসলাম বাবু, ওয়াশিকা আয়শা খান, জাসদের শিরীন আখতার, বিএনপির হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা, জাতীয় পার্টির ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, মুজিবুল হক চুন্নু প্রমুখ।

সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রস্তাবটি ছিল- ‘সংসদের অভিমত এই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্বের সংকট, উপর্যুপরি দুর্যোগের ভয়াবহ আঘাত এবং চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার বৃদ্ধি, জীব-বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা, ক্রমবর্ধমান পানি সংকট, মহাসাগরগুলোর ওপর অভাবনীয় চাপ এবং সম্পদের অমিতাচারী ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হউক।’

প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, মানুষের বসবাস উপযোগী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ পৃথিবী আজ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির কারণে বিপন্নপ্রায়। আমাদের প্রিয় এ গ্রহটি মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ জটিলতায় নিপতিত। অতিব্যবহার ও অপব্যবহারে সমুদ্রসম্পদ শেষ হয়ে আসছে। সামনের সময়ে সারা বিশ্বের প্রায় ২৩টি উন্নত দেশের পার্লামেন্ট তাদের দেশে জলবায়ু জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। কিন্তু যেসব কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সংকটের সৃষ্টি, বাংলাদেশ তার জন্য দায়ী না হলেও এর শিকার হতে চলেছে। তাই প্রস্তাবটি গৃহীত হলে সারাবিশ্বের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।

তোয়ায়েল আহমেদ বলেন, বিশ্ব পরিসরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ শিল্পায়নের পরিবর্তন। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ৭০ কোটি মানুষ নিচু এলাকায় বসবাস করছে, ভোলাসহ বাংলাদেশের অনেক মানুষ এর মধ্যে রয়েছে।

তিনি বলেন, আজ আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি, যেটি শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় আমরা ৬ষ্ঠ। ভবিষ্যতে আমাদের ১৯টি উপকূলীয় জেলা তলিয়ে যাবে। আগে প্রায় শত বছর পরে বড় ঝড় হতো। আর এখন দেখেন আইলাসহ কত ঝড় হচ্ছে। গত ১০ তারিখ আমাদের দশ নম্বর সিগন্যাল দিতে হয়েছিল। এসময় তিনি প্রস্তাবের সমর্থন জানিয়ে তা গ্রহণের আহ্বান জানান।

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, উন্নত বিশ্বের ২০ ভাগ লোক নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কার্বণ নি:সরণ করে। আর ৮০ ভাগ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা মানবতাবিরোধী কাজ। তাই জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে আহ্বান জানাই আমরা যেমন প্রস্তাব পাস করে অবহিত করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্পেনে যাবেন সেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে আমাদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের বিষয়টি তুলে ধরবেন। আপনিও (স্পিকার) বিভিন্ন ফোরামে আমাদের প্রস্তাবের বিষয় তুলে ধরবেন। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে আমাদের সাথে তামাশা করেছে এসব বিষয় তুলে ধরবেন।

তিনি বলেন, আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত আসছে। ইউনেস্কোর তথ্য মতে ১ কোটি ৯০ লাখ শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে উপকূলীয় এলাকার ১০টি জেলা বিলীন হয়ে যাবে।

পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দীন আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশও ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্বের ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ওঠা নামা করে। এর কারণে ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে প্রস্তাব করা হয়েছে, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্থন করছি।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, প্যারিস সম্মেলনে গৃহীত প্রতিশ্রুতিগুলো প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং সংকট মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সেগুলোও প্রস্তাবে থাকলে ভাল হতো।

নসরুল হামিদ বলেন, রামপালে যে কাজ হচ্ছে তার ফলে প্রতিদিন কি পরিমাণ প্রভাব পড়ছে সেটা আমরা প্রতিদিন পরীক্ষা করে দেখছি। আমরা দূষণ সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য মাস্টার প্লান করেছি। বর্তমানে ইটভাটা থেকে যে পরিমাণ কার্বণ নি:সরণ হচ্ছে তা রামপালের চেয়ে অনেক বেশি।

সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, আমরা বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বরফ গলে যাচ্ছে। বনভূমিগুলো পুড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, নোনা পানি ঢুকে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করছে। তাই যেসব রাষ্ট্র আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা সবাই মিলে ঐক্যজোট করে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি, তবে এটি ফলপ্রসু হবে।

জাসদের শিরীন আখতার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন প্রজন্মের আজ আকুতি- আগামী পৃথিবীতে আমাদের নিঃশ্বাসের ব্যবস্থা করে দাও। একদিকে হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে, বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে যাচ্ছে। এই সুন্দরবনকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে, বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে উপকূলে ব্যাপক বনায়ন করতে হবে, নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে।

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, সারাবিশ্বে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য আমরা মানুষরাই দায়ী। আমাদের ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিয়েছি, সেটাই বড় কথা। ঢাকা মহানগরীতে দুই কোটি মানুষ বসবাস করছে, কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা কী পদক্ষেপ নিয়েছি? উন্নত দেশগুলো কয়লা বর্জন করলেও আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছি কেন?

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকি ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ এ জন্য বাংলাদেশ মোটেও দায়ী নয়। প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না। সবাইকে একজোট হয়ে সংকট সৃষ্টিকারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

জাতীয় পার্টির ডা. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারাবিশ্বে অক্সিজেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের ফলে আমাদের মতো দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে পড়েছে। কার্বন নিঃসরণ বন্ধ না হলে সারাবিশ্বই হবে বসবাসের অনুপযোগী।

এ সম্পর্কিত আরও খবর