শতবর্ষে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন

বিবিধ, রাজনীতি

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:33:06

বিগত উনিশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অনেক বিপ্লবী ব্রিটিশ শাসিত ভারতের ভেতরে ও বাইরে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির আন্দোলন শুরু করেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলে অনেকেই কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিপ্লবের নেতা লেনিন ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার করতে ও দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার প্রেরণা যোগাতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বা 'কমিনটার্ন' স্থাপন করেন ১৯১৯ সালে। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায় (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)-এর সক্রিয়তায় সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মধ্য এশিয়ার তাসখন্দ শহরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠা কালে পার্টির সভ্য হন ৭ জন: ১) মানবেন্দ্রনাথ রায়, ২) এভেলিন ট্রেন্ট রায়, ৩) অবনী মুখার্জি, ৪) রোজা ফিটিংহফ, ৫) মুহম্মদ আলি (আহ্‌মদ হাসান), ৬) মুহম্মদ শফিক

সিদ্দিকী, ৭) এম বি টি আচার্য বা এম প্রতিবাদী আচার্য। পার্টির সম্পাদক হন মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। কমিনটার্ন ১৯২১ সালে সিপিআই-কে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯২১-২২ সময়কালে ভারতের কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, লা‍হোর, কানপুর শহরকে কেন্দ্র করে পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন মুজফ্ফর আহ্‌মদ, এস এ ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, গোলাম হুসেন প্রমুখ নেতারা।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬তম অধিবেশনে (আহমেদাবাদে ১৯২১ সালে) এবং  ৩৭তম অধিবেশনে (গয়ায় ১৯২২ সালে) সিপিআই প্রকৃত স্বাধীনতার ইশ্‌তেহার প্রকাশ করে। কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন মৌলানা হসরত মোহানি, যিনি ১৯২৫ সালে কানপুরে সিপিআই-এর সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। প্রস্তাব সমর্থন করেন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন স্বামী কুমারানন্দ। কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন এম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, যিনি ১৯২৫ সালে পার্টির কানপুর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন কমিউনিস্টদের উদ্যোগে ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে মাদ্রাজের সমুদ্র সৈকতে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের সভাপতিত্বে তার মেয়ের লাল কাপড়কে লাল পতাকা করে।

কমিনটার্নের পক্ষ থেকে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলায় সাহায্য করত গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ফিলিপ স্প্রাট ও বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি (ব্রেন ব্রাডলি) মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হন। ব্রিটেনের পার্টির দুই নেতা রজনী পাম দত্ত ও ব্রেন ব্রাডলি ভারতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট গড়ে তোলার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ১৯৩৬ সালে এক দলিল উপস্থিত করেন, যা ‘দত্ত-ব্রাডলি থিসিস’ নামে পরিচিত।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম থেকেই ব্রিটিশ শাসকদের কাছে বিপজ্জনক ছিল। ফলে ১৯২১ সাল থেকেই পার্টির ওপর আক্রমণ নেমে আসে। ১৯২১-২৭ সালে পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯২৩-২৪ সালে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯২৯-৩৩ সালে মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা চলে, যদিও ভারতে ১৯৩৪-৪২ সালে এবং স্বাধীন ভারতে ১৯৪৮-৫১ সালে পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। এরই মাঝে ১৯২০ সালে স্থাপিত হয় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, ১৯৩৬ সালে সারা ভারত কৃষকসভা, ১৯৩৬ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন, ১৯৩৬ সালে নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ, ১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ।

উনিশ শতকের চারের দশকে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ত্রিপুরায় রিয়াং বিদ্রোহ (১৯৪২), মালাবারে কায়ুর বিক্ষোভ (১৯৪৩), মহারাষ্ট্রে ওয়ারলি আদিবাসী অভ্যুত্থান (১৯৪৫-৪৬), ময়মনসিংহের হাজং বিদ্রোহ (১৯৪৫-৪৭), ত্রিবাঙ্কুরের পুন্নপ্রা-ভায়ালার বিদ্রোহ (১৯৪৬), বাংলার তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭)-এর মধ্য দিয়ে কৃষকেরা যে তরঙ্গ সৃষ্টি করে, যার নেপথ্যে ভূমিকা রাখে কমিউনিস্ট পার্টি।

একই সাথে বোম্বাই, করাচি, কোচিন, কলকাতা, বিশাখাপত্তনম ইত্যাদি বন্দরগুলোতে নৌ বিদ্রোহ (১৯৪৬) সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জলোচ্ছ্বাসে পরিণত করে। বিদ্রোহের সমর্থনে শ্রমিক শ্রেণি এগিয়ে এলে  বৃহত্তম ধর্মঘট ও হরতাল সংগঠিত হয়। ব্রিটিশ পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনায় সরকারি মতে ২২৮ জন, বেসরকারি মতে প্রায় ৫০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এরই মাঝখানে আইএনএ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ১৯৪৫ সালে কলকাতায় ছাত্র-যুব বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও আব্দুস সালাম।

১৯৪৬ সালে সারা  ভারতে ডাক-তার-টেলিকম কর্মীদের সমর্থনে সাধারণ ধর্মঘট হয়, আইএনএ ক্যাপ্টেন রসিদ আলির মুক্তির দাবিতে কলকাতা, বোম্বাই সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৬-৫১ সালে পরিচালিত হয় তেলেঙ্গানার কৃষক সংগ্রাম। বীরত্বপূর্ণ এই গণঅভ্যুত্থানে ৪ হাজার (কোনো কোনো অনুসন্ধানকারীর মতে ৬ হাজার) মানুষ নিহত হন, ১০ হাজারের বেশি মানুষ জেল ও বন্দিশিবিরে আটক থাকেন, অন্তত ৫০ হাজার মানুষ দিনের পর দিন পুলিশ ও সেনা শিবিরে নিগৃহীত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন।

১৯৪৭ সালে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পরও পণ্ডিচেরী, গোয়া ও দেশের আরও কিছু অংশ ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল। ১৯৫৪ সালে ফরাসিদের কবল থেকে পণ্ডিচেরী ও অন্যান্য অংশ মুক্ত করায় এবং ১৯৫৫ সালে পর্তুগীজদের কবল থেকে গোয়া ও অন্যান্য অংশ মুক্ত করায় কমিউনিস্টদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ক্রমশ যোগ দিয়েছেন। জাতীয় বিপ্লববাদী গদর পার্টির নেতা ভগৎ সিংয়ের যারা সহকর্মী ছিলেন, সূর্যসেনের যারা সহযোদ্ধা ছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসুর যারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা অনেকেই পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন পৃথ্বী সিং আজাদ, বাবা সোহন সিং ভাকনা, আমীর হায়দার খান, নানা পাতিল, ঝাড়খণ্ড রাই, সরযূ পাণ্ডে, অরুণা আসফ আলী, প্রমোদ সেনগুপ্ত, লক্ষ্মী সায়গল (স্বামীনাথন), অজয় ঘোষ, সোহন সিং যোশ, ইরাবত সিং, কল্পনা যোশী (দত্ত), শিব ভারমা, গণেশ ঘোষ, সুবোধ চৌধুরী, অম্বিকা চক্রবর্তী প্রমুখ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে আন্দামানের সেলুলার, রাজপুতানার দেউলি, বাংলার প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি জেল ও বন্দি শিবিরগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ‘কমিউনিস্ট কনসলিডেশন’ গড়ে তোলেন, বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে অনেকেই পরবর্তীকালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নেতৃত্ব দেন। এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছেন বাংলায় প্রমোদ দাশগুপ্ত, সতীশ পাকড়াশী, নারায়ণ রায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সুধাংশু দাশগুপ্ত, বিজয় মোদক, সুকুমার সেনগুপ্ত, ভূপাল পান্ডা, সত্যব্রত সেন, অমৃতেন্দু মুখার্জি প্রমুখ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ১৯৬৩-৬৪ সালে মতাদর্শগত মহাবিতর্কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়। অনেকেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করলেও বহু কমিউনিস্ট গ্রুপ সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে, যার অন্যতম ছিল নকশাল আন্দোলন।

তদুপরি শতবর্ষের উত্থান-পতনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের একাধিক রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতে কমিউনিস্টরা বহু বছর শাসন পরিচালনা করেন এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পান। একশ বছরের পরিক্রমায় ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টি নামে বহু দল ও গ্রুপ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর