ছাত্রদলের যুগ্ন আহবায়ক হলেন ছাত্রলীগের সভাপতি!

আওয়ামী লীগ, রাজনীতি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 09:28:51

ফরিদপুরের ভাঙ্গা কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ন আহবায়ক চয়ন কুমার মন্ডলকে সদ্যঘোষিত নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে চয়ন কলেজ ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সত্ত্বেও তথ্য গোপন করে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ায় এলাকায় সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। শুধু তথ্য গোপনই নয়, চয়ন কুমার মন্ডলের নামে নগরকান্দা থানায় চুরি, মারধর, হত্যাচেষ্টা ও নাশকতাসহ অন্তত ৩টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সে চার্জশীটভুক্ত আসামি। এতোগুলো মামলা থাকার পরেও চয়ন কুমার মন্ডলের নাম কিভাবে উপজেলা ছাত্রলীগের মত দায়িত্বশীল পদে আসে সেটা নিয়েও এলাকায় আলোচনা সমালোচনা চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চয়ন কুমার মন্ডল ভাঙ্গা সরকারি কে এম কলেজের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। চলতি বছরের এপ্রিলে ভাঙ্গা কলেজ ছাত্রদলের আহবায়ক কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পান চয়ন। ৩০ এপ্রিল ছাত্রদলের ঘোষিত কমিটিতে ১১ নং যুগ্ন আহবায়ক করা হয় চয়ন কুমার মন্ডলকে। তবে কলেজ ছাত্রদলের কমিটিতে থাকা অবস্থায়ই চয়নকে আবার নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়েছে। তাই ছাত্রদল থেকে রাতারাতি ছাত্রলীগ সভাপতি বনে যাওয়ায় এতে সংগঠনটির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সৈয়দ আদনান হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হাসান ২১ সদস্যবিশিষ্ট ভাঙ্গা কাজী মাহবুবউল্যাহ সরকারি কলেজ ছাত্রদলের একটি আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেন। ওই কমিটির একজন আহ্বায়ক, ১৪ জন যুগ্ম আহ্বায়ক, একজন সদস্যসচিব এবং বাকি সবাই সদস্য। ঘোষিত ওই কমিটির ১২ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছে চয়ন কুমার মন্ডলের নাম।

অপর দিকে গত ৩১ জুলাই (শনিবার) নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি অনুমোদন দেন ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগ। ঘোষিত ওই উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়ে মোট ১২ সদস্যবিশিষ্ট। দলীয় প্যাডে স্বাক্ষর দিয়ে এ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তামজিদুল রশিদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ। ঘোষিত ওই উপজেলা কমিটিতেও সভাপতি হিসেবে রয়েছে চয়ন কুমার মন্ডলের নাম। এতে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের দুই কমিটিতে একই ব্যক্তির নাম থাকায় উপজেলাব্যাপী হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ভাঙ্গা সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি সোহেল মৃধার ফোনে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় সোহেল মৃধা এক মামলায় প্রায় দুই মাস ধরে কারাগারে আছেন।

পরে এ বিষয়ে ভাঙ্গা কলেজ ছাত্রদলের ১ নং যুগ্ন আহব্বায়ক হামিদুর রহমান বলেন, চয়ন ভাঙ্গা কলেজের প্রভাষক রঞ্জিত কুমার মন্ডলের ভাতিজা। সেই সুবাদেই ‘আমি তাকে রাজনীতিতে এনেছি। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছি। ছাত্রদলের রাজনীতিতে সে সক্রিয় ও সরব ছিলো। এমনকি গত কয়েক মাস আগে কলেজ ছাত্রদলের নব ঘোষিত কমিটিতে সে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে। বর্তমানে চয়ন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। তবে হঠাৎ তিনদিন আগে শুনলাম সে উপজেলা নগরকান্দা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। এতে আমি বিস্মিত হয়েছি। তবে আজ পর্যন্ত তিনি কোনো পদত্যাগ বা অব্যাহতিপত্র দেয়নি।’ এ বিষয় তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে চয়ন কুমারের বিরুদ্ধে নগরকান্দার ছাত্রলীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করে বলেন, শুধু ভাঙ্গা কলেজই না, চয়ন ভাঙ্গা উপজেলা ও পৌর ছাত্রদলের প্রতিটি মিটিং-মিছিলেও সরব উপস্থিত থাকতেন। তবে হঠাৎ ছাত্রলীগে ডিগবাজি দেন। যদিও তিনি এ সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য ফরমও পূরণ করেননি। ছাত্রলীগের কোন কমিটিতেও তার নাম নেই। তবুও তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার আমরা অবাক হয়েছি। এবং কোন অদৃশ্য শক্তির জোরে তিনি সভাপতি হলেন সেটা বুঝে উঠতে পারছি না।

নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের কর্মী সৈকত শিমুল বলেন, ‘এটা তো ছাত্রলীগের কমিটি না, ছাত্রদলের কমিটি। তা না হলে ছাত্রদলের লোক কিভাবে কমিটিতে জায়গা পায়। আমরা যারা দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতি করি তাদের কাউকে না জানিয়ে জেলা ছাত্রলীগের নেতারা মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে গোপনে এ কমিটি ঘোষণা করেছেন।

এদিকে ভাঙ্গা কাজী মাহবুবউল্যাহ সরকারি কলেজের ব্যবস্থপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম বলেন, গত তিন চার দিন ধরে ফেসবুকে ভুগোল বিভাগের বড় ভাই চয়ন কুমার মন্ডলকে কলেজের সবাই অভিনন্দন জানিয়ে পোষ্ট দিচ্ছে। তিনি নাকি নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছে। কিন্তু আমরাতো তাকে ভাঙ্গা কলেজে ছাত্রদলের সোহেল ভাই, সবুজ ভাই, নিরা ভাই, রহমান ভাইদের সাথে রাজনীতি করতে দেখেছি। এখন হঠাৎ করে কিভাবে সে নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হলো সেটা আমি ভেবে পাচ্ছি না।

এ বিষয়ে চয়ন কুমার মন্ডলের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, এটা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, আমার নামে কোন মামলা নেই। আর আমি আজীবন ছাত্রলীগ করেছি, ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। আমি ও ছাত্রদলের চয়ন এক ব্যক্তি নন। আমি ভাঙ্গা কলেজে লেখাপড়া করি কিন্তু ওখানে ছাত্রদলের চয়ন কুমার মন্ডল নামের কাউকে চিনি না। এ নামে ভাঙ্গা কলেজে আছে কেউ আছে বলেও আমার জানা নেই।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরানকে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের এ কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রে আমি এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক কোন নেতার কাছ থেকে কোনো পরামর্শ নেয়া হয়নি। কমিটি ঘোষনার পর জানতে পারলাম ছাত্রদলের রাজনীতি করা চয়নকে সভাপতি করা হয়েছে। আমি দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম তাই ভাঙ্গার অনেক নেতাকেই চিনি।

চয়ন ছাত্রদল করতো এটা আমি অনেক আগে থেকেই অবগত। এজন্যই চয়নকে ছাত্রলীগের কমিটিতে দেখে অবাক হয়েছি। এটা ছাত্রলীগের জন্য লজ্জাজনক। এর মাধ্যমে নগরকান্দা ছাত্রলীগের কবর রচিত হবে বলে মনে করি। তিনি বলেন, হয়তো নগরকান্দায় ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার কেউ যোগ্য ছিলনা বলেই ছাত্রদল নেতাকে দিয়ে চালিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে আমি বলব যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু জেলা ছাত্রলীগের নেতাদের উচিত হবে অভিযোগের তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হাসান কায়েস বলেন, আসলে কেউ যদি ছাত্রদলের পদে আসতে চায় তাহলে তার সমস্ত ডকুমেন্ট জেলা ছাত্রদলকে জমা দিতে হয়। পরে আমরা সেটা যাচাই-বাছাই করে কমিটি দেই। কিন্তু ছাত্রদলের পদে থাকার পরেও যদি কাউকে ছাত্রলীগে নেয়া হয় সেটা একান্ত ছাত্রলীগের ব্যাপার। এমন কোন ঘটনা ঘটলে আমরা তাকে দল থেকে বহিস্কার করবো। আলফাডাঙ্গায়ও এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। ওই ছেলে রনি কিন্তু আবেদন করে অনেক আগেই ছাত্রদলে এসেছে। তারপরেও অন্তত ৬ মাস পরে আবার তার নাম ছাত্রলীগে এসেছে। এতে আমাদের দোষ কি? একটা ছেলে ছাত্রদলের চলতি কমিটিতে থাকতে কিভাবে তারা তাকে আবার ছাত্রলীগে নিলো? তাতে বোঝা যায় ছাত্রলীগ যাচাই-বাছাই না করে কমিটি দেন।

তবে কমিটি ঘোষণাকারী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তামদীদুল রশিদ রিয়ান বলেন, চয়ন ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না জেনেও চাপে পড়ে তাঁকে কমিটির সভাপতি করতে বাধ্য হয়েছি। তবে কিসের চাপ, তা তিনি স্পষ্ট করে বলতে রাজি হননি। রিয়ান বলেন, চয়ন কলেজ ছাত্রদলের পদে ছিলো এটা আমার জানা ছিলো না।

চয়নের বিরুদ্ধে রজু হওয়া মামলার এজহার পর্যালোচনা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর তালমা বাজারে ভ্যান স্ট্যান্ডের কাছে এস এস ইলেকট্রনিক্সের দোকানের সামনে উপজেলার মানিকদির বাসিন্দা তারেক মল্লিক (৩০) পথরোধ করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মারধর ও কুপিয়ে জখম করে তার কাছ থেকে নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান চয়ন কুমার মন্ডল। ওই ঘটনায় পরদিন তারেক মল্লিক বাদি হয়ে নগরকান্দা থানায় চয়ন কুমার মন্ডলসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে চুরি ও হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৭/২০।

এছাড়াও অভিযুক্ত চয়ন ২০২০ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধ নিয়ে উপজেলার তালমার মোড় রাজ্জাকের চায়ের দোকানের সামনে থেকে নগরকান্দার ঝাউডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মজনু পাটোয়ারীকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে উপর্যপুরি কুপিয়ে গুরতর আহত করে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় মজনু পাটোয়ারী বাদি হয়ে চয়নকে আসামি করে নগরকান্দা থানায় একটা হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলা নং ১৩/২০।

এছাড়া ২০২০ সালের ৮ আগস্ট রাজনৈতিক মতবিরোধকে কেন্দ্র করে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা ফিরোজ খানের নেতৃত্বে চয়ন কুমার মন্ডলসহ আরো বেশ কয়েকজন যুবক দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে উপজেলার পিপরুল গ্রামের ছামাদ মাতুব্বর (৬০) এর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে মারধর বাড়িঘর ভাংচুরসহ মালামাল লুটপাট করে পালিয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ছামাদ মাতুব্বর বাদী হয়ে নগরকান্দা থানায় চয়ন কুমার মন্ডলসহ আর ৮-১০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ০৯/২০।

এ সম্পর্কিত আরও খবর