দুই ধারায় বিভক্ত সিলেট আওয়ামী লীগ!

আওয়ামী লীগ, রাজনীতি

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-09-01 12:01:09

প্রায় ৪ বছর পর সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্র। কমিটিতে নিজেদের পছন্দের লোক এবং বলয় 'মাইনাস' হওয়ায় সিলেট ছাত্রলীগে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এরইমধ্যে ঘোষিত কমিটি নিয়ে কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন পদবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা। ছাত্রলীগের এমন অস্থিরতায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে সিলেট আওয়ামী লীগ। একপক্ষ অবস্থান নিয়েছেন কমিটির পক্ষে অপর পক্ষ কমিটি ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

কমিটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রণজিৎ সরকার। বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন মহানগরের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমেদ, জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও মহানগরের সহ সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ।

তাদের অভিযোগ কমিটি গঠনে ছাত্রলীগের দ্বায়িত্বশীল নেতারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেননি। নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তারা এই কমিটির কোনও দায়-দায়িত্ব নেবে না।

জানা গেছে, কমিটি ঘোষণার পরই মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির বাসায় জরুরি বৈঠকে বসেন জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, মহানগরের সহ সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। বৈঠক থেকে কমিটির বিষয়ে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ বিষয়ে বার্তা পাঠানো হয়। প্রয়োজনে এ বিষয়ে তারা দলীয় প্রধানের সাথে দেখা করতে পারেন বলে জানা গেছে।

তবে কমিটি নিয়ে অনড় অবস্থানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তাদের দাবি স্বচ্ছ ও ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিজের বলয়ের লোক পদবঞ্চিত হওয়ায় অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ তুলা হচ্ছে। যা মিথ্যা ও বানোয়াট উল্লেখ করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।

তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, কমিটিতে স্বচ্ছ, যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। লেনদেনের প্রশ্নই আসে না, এটা কেউ প্রমাণও করতে পারবে না।

সবার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে লেখক বলেন, কমিটিতে সবাইতো আর সভাপতি-সম্পাদক হতে পারবেনা। এক্ষেত্রে যারাই বাদ পড়ছেন তারা অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন।

এদিকে, নিজ বলয়ে কোণঠাসা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন দুই কমিটির শীর্ষ নেতা ও তাদের বলয়ের নিয়ন্ত্রক নেতারা। তারা গোপনে রাহেল সিরাজের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। তবে এই মুহূর্তে তারা সরাসরি রাহেল সিরাজের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না।

সূত্রের খবর, শেষ পর্যন্ত জেলার কোনও নেতা রাহেল সিরাজের দায়িত্ব না নিলে তাকে শেল্টার দেবেন গোলাপগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। তিনি সাবেক কয়েকজন ছাত্রনেতাকে সামনে রেখে রাহেল সিরাজকে দিয়ে জেলার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের চেষ্টা চালাবেন।

সূত্র আরও জানায় রাহেল সিরাজ বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠকও করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে সব ধরনের সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল-পরশুর মধ্যে তিনি বিমানযোগে সিলেট আসবেন। এরপর বিশাল শোডাউন করে সিলেটে নিজের অবস্থান জানান দেবেন রাহেল সিরাজ।

জানা গেছে, একসময় সিলেট ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক ছিলেন চার নেতা। চারজনই ছিলেন এককালের তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা। তারা হলেন-‘তেলিহাওর গ্রুপ’র নিয়ন্ত্রক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খাঁন, 'দর্শন দেউড়ি গ্রুপ’র নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, 'কাশ্মীর গ্রুপ'র নিয়ন্ত্রক মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও 'টিলাগড় গ্রু'র নিয়ন্ত্রক জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রণজিৎ সরকার।

সিলেট ছাত্রলীগের রাজনীতিতে এ চার গ্রুপ বেশি আলোচিত। জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি এলেই শীর্ষ চার পদ পেতেন এ চার গ্রুপের অনুসারীরা। প্রায় দুই যুগ ধরেই ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিল এই চার নেতার অনুসারীদের আধিপত্য।

তবে ২০১৫ সালে দীর্ঘদিনের আধিপত্যে ভাগ বসান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আাজাদুর রহমান আজাদ। সে কমিটিতে 'কাশ্মীর গ্রুপ'কে 'মাইনাস' করে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক হন 'শাহজালাল ব্লক'র নিয়ন্ত্রক আসাদ উদ্দিন আহমেদের অনুসারী আব্দুল আলিম তুষার। অপরদিকে জেলায় 'টিলাগড় গ্রুপ'কে 'মাইনাস' করে সাধারণ সম্পাদক হন আজাদুর রহমান আজাদ অনুসারী রায়হান চৌধুরী।

সবশেষ ২০২১ সালেও পুরোনো তিন ছাত্রলীগ নেতা তাদের বলয়ের আধিপত্য ধরে রাখেলও বাদ পড়ে 'তেলিহাওর গ্রুপ'। আধিপত্য ধরে রাখতে পারেনি আজাদুর রহমান আজাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা 'টিলাগড় গ্রুপ' ও আসাদ উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে থাকা 'শাহজালাল ব্লক'।

অন্যদিকে, এবারও নিজেদের বলয়ের আধিপত্য ধরে রেখেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রণজিৎ সরকারের অনুসারীরা। নাদেলের নিয়ন্ত্রণে থাকা 'দর্শন দেউড়ি' গ্রুপ থেকে কিশোয়ার জাহান সৌরভ হয়েছেন মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বিধান কুমার সাহার ‘কাশ্মীর গ্রুপে’র নাঈম আহমদ। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের ‘টিলাগড় গ্রুপ’র অনুসারী নাজমুল ইসলাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছেন।

এদিকে, জেলার সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজকে নিয়ে দেখা দিয়েছে রহস্য। রাহেল মূলত ‘তেলিহাওর গ্রুপ’র কর্মী। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবেও দায়িত্বে আছেন। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রক। ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পরই এ বলয়ের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা রাহেলের বাসায় হামলা ও গুলিবর্ষণ করায় দেখা দিয়েছে রহস্য। ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, নাসির উদ্দিন খানের ভাতিজা জাওয়াদকে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক না করায় এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। জাওয়াদ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে ঠাঁই পেয়েছেন। অবশ্য কমিটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেন।

অবশ্য রাহেল সিরাজ নিজেকে তেলিহাওর গ্রুপের অনুসারী দাবি করে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, নাসির উদ্দিন খান আমার রাজনৈতিক অভিভাবক। আমি জানিনা কেন আমার গ্রুপের অনুসারী ও সহকর্মীরা আমাকে মেনে নিতে পারছেনা। তারা আমার বাসায় হামলা চালাচ্ছে; এটা আমার বোধগম্য নয়।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় না করে কমিটি দেওয়াটা কেন্দ্রের ঠিক হয়নি। মূলত এ কারণেই নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। এছাড়া কেন্দ্রের পছন্দও সঠিক ছিলো না বলে তিনি জানান।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উচিৎ ছিলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে কমিটি অনুমোদন দেওয়া। কিন্তু কেন্দ্রের নেতার কাউকে না জানিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া হুটহাট কমিটি ঘোষণা করায় সিলেট ছাত্রলীগে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে।

এদিকে, কমিটি গঠনে কোটি টাকা বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা।

সবশেষ শনিবার (১৬ অক্টোবর) নগরে মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন পদবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা। মানববন্ধন থেকে কমিটি বাতিলের জোর দাবি জানান বিদ্রোহীরা।

একই দাবিতে গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করেন পদবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা।

এর আগে গত বুধবার বিকালে সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে জেলার সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে অছাত্র, এমসি কলেজের হোস্টেলে ধর্ষণ মামলার আসামিদের গডফাদার, বিভিন্ন চেক ডিজঅনার মামালার আসামি, বিশেষ করে ফ্রিডম পার্টির নেতার নাতিকে নিয়ে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করায় আমরা সিলেট ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লজ্জিত, হতাশ ও বিব্রত। আমরা কমিটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।

এ কমিটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন ও অবরোধসহ টানা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর