রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী আসন মোট তিনটি। বিএনপির অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মানিকগঞ্জ জেলা। তবে বিগত চারটি জাতীয় নির্বাচনে মানিকগঞ্জ জেলার সংসদীয় আসনগুলো ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। গত নির্বাচনে মানিকগঞ্জের তিন আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় সাবেক স্বাস্থমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ জাহিদ নামের আরও দুই জন। যাদের সবাই এখন আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে বিভিন্ন সূত্রে।
গত ৫ আগষ্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পরপরই লাপাত্তা হয় মানিকগঞ্জের এই তিন সংসদ সদস্য। মানিকগঞ্জ-১ ও মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ ও জাহিদ আহমেদ টুলু। তারা দুই জনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও পদধারী নেতা। তবে মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন সাবেক সাবেক স্বাস্থমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মানিকগঞ্জের তিনটি আসন ছিল তিন জাহিদের দখলে। তাদের কারোরই এখন খোঁজ নেই নিজ নিজ এলাকায়। গ্রামের বাড়ীতেও নেই তারা। ফলে তাদের আত্মগোপনে থাকার বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। অনেকের ধারণা তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, দেশের মাটিতে থাকলে তারা শিগগিরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কব্জায় আটকা পড়বেন।
মানিকগঞ্জ-১
ঘিওর-দৌলতপুর-শিবালয় উপজেলা নিয়ে মানিকগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন গঠিত। স্বাধীনতার পর থেকে বেশিরভাগ সময় এই আসনটি বিএনপির দখলে থাকলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটি চলে যায় নৌকার দখলে। বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে হারিয়ে এই আসনের নেতৃত্ব যায় আওয়ামী লীগের এ.বি এম আনোয়ারুলের নিকট। তবে পরবর্তী নির্বাচনে তিনি মনোয়নয় পাননি এই আসন থেকে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসনে নৌকার মনোনয়ন পান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় এ. এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়। জাতীয় পার্টির প্রার্থী আফজাল হোসেন খান জকিকে হারিয়ে বিজয়ী হন তিনি। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার নৌকার মনোনয়ন পান দুর্জয়। এসময় প্রয়াত মহাসচিবের্ ছেলে আব্দুল হামিদ খান ডাবলুকে হারিয়ে বিজয়ী হন তিনি। পরে সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল আলম রুবেল। তবে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হন।
নির্বাচনের পরপরই নির্বাচনী এলাকায় বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। এরই মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর তিনিও চলে যান আত্মগোপনে। অনেকের ধারণা এরই মধ্যে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন এস.এম জাহিদ। আগেই থেকেই তার পরিবার বসবাস করেন কানাডায়। তারও সেখানকার নাগরিকত্ব আছে বলে কথিত রয়েছে। তবে এস. এম জাহিদের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কোন তথ্য দিতে পারেনি কেউই।
মানিকগঞ্জ-২
সিংগাইর-হরিরামপুর এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি আসন নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-২ আসন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এস. এম মান্নান এই আসন থেকে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পান। পরে বিএনপি নেতা মঈনুল ইসলাম খান শান্তকে হারিয়ে নির্বাচিত হন তিনি। সেই সময়ে সংরক্ষিত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আলোচিত-সমালোচিত কন্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম।
২০১৪ সালে নৌকার টিকিট পেয়ে খালি মাঠে গোল দিয়ে সংসদে যান মমতাজ বেগম। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও নৌকার মনোনয়ন পান তিনি। পরে বিএনপি নেতা মঈনুল ইসলাম খান শান্তকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়ে ফের সংসদে যাবার পথ সুগম হয় মমতাজের। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর নিকট পরাজয় হয় মমতাজের।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হলেও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ আহমেদ টুলুও রয়েছে আত্মগোপনে। খোঁজ নেই মমতাজ বেগমেরও। তবে ব্যক্তি জীবনে সফল ব্যবসায়ী জাহিদ আহমেদ টুলু ঢাকায় বা দেশের অন্য কোথাও বেশ নিরাপদে রয়েছে বলে দাবি এলাকাবাসীর। মমতাজ বা জাহিদ আহমেদ টুলু ছাড়াও পলাতক রয়েছে এই আসনের পদধারী সব নেতারাই।
মানিকগঞ্জ-৩
সাটুরিয়া ও মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-৩। নৌকা প্রতীকে টানা চার বার এই আসন থেকে বিজয়ী হয় জাহিদ মালেক। প্রথমে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ও পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও শেষ সময়ে কোন মন্ত্রীত্ব পাননি তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিএনপি নেতা হারুনার রশীদ খান মুন্নুকে পরাজিত করে সংসদে যাওয়ার পথ খোলে জাহিদ মালেক স্বপনের।
এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফের সংসদ সদস্য হয় জাহিদ মালেক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণফোরামের নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামালকে হারিয়ে তৃতীয় বারের মতো বিজয়ী হন জাহিদ। সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও মফিজুল ইসলাম খান কামালকে পরাজিত করে টানা চার বারের সংসদ সদস্য নিরর্বাচিত হন জাহিদ মালেক।
সরকার পতনের আগে থেকেই জাহিদ মালেকের অবস্থান নড়বড়ে হতে শুরু করে। স্বাস্থ্য অধিদফরের নানা কেলেঙ্কারি ছাড়াও সানলাইফ ইনস্যুরেন্স, নিজ ও পরিবারের নামে-বেনামে জমি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়াদিসহ একাদিক বিষয়ে আলোচিত-সমালোচিত হন জাহিদ মালেক। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও ছিলো না তেমন বনিবনা। চার বারের এই সংসদ সদস্য এখন আত্মগোপনে। গ্রামের আলিসান বাড়িতে নেই পরিবারের কেউই। তবে মালেকের দেশ ত্যাগের সুযোগ মিলেনি বলে ধারণা অনেকের।
শুধুমাত্র এই তিন সংসদ সদস্যই নয়। আত্মগোপনে রয়েছে আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় সকল নেতাকর্মীরা।