এরশাদের কথাই শেষ কথা!

বিবিধ, রাজনীতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-22 12:41:32

জাতীয় পার্টির ভেতরে গণতন্ত্র বলতে কিছুই নেই, দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথাই শেষ কথা। তিনি যখন যাকে খুশি শোকজ বা বহিষ্কার করেন। আবার যখন যাকে খুশি প্রমোশন দেন। গঠনতন্ত্রে সেই পদ থাকুক আর নাই থাকুক তাতেও কিছুই যায় আসে না।

সম্প্রতি একই ব্যক্তিকে এক মাসের ব্যবধানে দু’বার প্রমোশন দিয়েছেন এরশাদ। পার্টিতে যোগদানের আগেই সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ প্রেসিডিয়ামের সদস্য করা হয়েছে এমন হাস্যকর নজিরও রয়েছে জাপায়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রেসিডিয়ামের সভায় ৪১ জন সদস্য রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই প্রেসিডিয়ামের সভায় সদস্য সংখ্যা এখন ৪৬ জন।

অবশ্য পার্টির গঠনতন্ত্রে এরশাদকে অনেকটাই স্বেচ্ছাচারী ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা (১) এ বলা হয়েছে, গঠনতন্ত্রের অন্যধারায় যাই উল্লেখ থাকুক না কেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত থাকবেন। এ ক্ষমতাবলে তিনি প্রয়োজন বোধে প্রতিটি স্তরের কমিটি গঠন, পুনঃগঠন, বাতিল, বিলোপ করতে পারবেন। তিনি যেকোনো পদ সৃষ্টি বা অবলুপ্ত করতে পারবেন। চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির যেকোনো পদে যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, যেকোনো পদ থেকে যেকোনো ব্যক্তিকে অপসারণ ও যেকোনো ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারবেন।

২০১৬ সালে জানুয়ারি মাসে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা হয়। তখন গঠণতন্ত্রে এই পদ ছিল না। রংপুরের এক জনসভায় এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন। এর অল্পদিনের মাথায় রওশন পন্থীদের চাপে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয়। সেই পদও গণতন্ত্র মোতাবেক ছিল না। পরে কাউন্সিলে (১৪ মে ২০১৬) গঠনতন্ত্রের সংশোধনী এনে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদ সংযোজন করা হয়।

এদিকে গত ১৮ জানুয়ারি জিএম কাদেরকে পার্টির ভবিষ্যত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন এরশাদ। গঠনতন্ত্রে কিন্তু এমন কোনো সুযোগ নেই। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি চেয়ারম্যান চাইলে অন্য কাউকে আজীবন চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারবেন! যে ছোট ভাইকে নিয়ে তার এত উচ্চাশা তাকেই হঠাৎ করে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। প্রশ্ন উঠেছে জাপায় আরেকটি ভাঙন আতি আসন্ন।

সিনিয়র অনেক নেতা নাখোশ হলেও তৃণমূলের নেতাদের কাছে অনেক জনপ্রিয় জিএম কাদের। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে এবং পরের ভূমিকায় তৃণমূলের কর্মীর চোখে হিরোয় পরিণত হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে এরশাদ যখন নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দেন, তখন নির্দেশ অমান্য করে সিনিয়র নেতারা প্রায় সকলেই রওশনের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেন।

জিএম কাদেরসহ হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন এরশাদের পক্ষে একাট্টা। এ কারণে এরশাদ ভক্তরা অন্যদের বেইমান মনে করলেও জিএম কাদেরকে প্রকৃত এরশাদের অনুসারী মনে করেন। তাই সেই জিএম কাদেরকে এভাবে অপদস্ত করার বিষয়টি অনেকে ভাল চোখে দেখছেন না। বিশেষ করে চিঠির কড়া ভাষায় অনেকে মর্মাহত।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন এরশাদ এমন ভাষা লিখতে পারেন না। তার থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। কেউ কেউতো এরশাদের স্বাক্ষর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। একজন ফেসবুকে এরশাদের দু’টি চিঠি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছে দু’টি স্বাক্ষর দু’ধরনের।

জাতীয় পার্টিতে কখন কার প্রমোশন হয়, আর কখন কাকে বহিষ্কার করা হয় তারও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ছোট ভাই জিএম কাদেরও এই শোকজের হাত থেকে রক্ষা পাননি। কাউন্সিলের বাইরে গিয়ে কয়েক বছরে তিন দফায় শুধু মহাসচিব পদেই রদবদল করেছেন। প্রথমে হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে, পরে বাবলুকে সরিয়ে আবার হাওলাদারকে মহাসচিব করেন। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে হাওলাদারকে সরিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব করেছেন। আবার হাওলাদারকে কয়েকদিনের মাথায় সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী করেছেন।

এরশাদের এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে এখন বহুভাগে বিভক্ত জাপা। এরশাদের নেতৃত্বে মূলধারার জাপাসহ জাতীয় পার্টি জেপি, বিজেপি ও জাতীয় পার্টি জাফর নামে চারটি ধারা সক্রিয়। দু’টি ধারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এবং অন্য দুটি ধারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত রয়েছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। বয়সগত কারণে তার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া বেশ কঠিন। এ কারণে এরশাদের অবর্তমানে পার্টিকে কব্জায় নিতে একটি গ্রুপ মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা কাদেরকে সরিয়ে নিজেদের পথকে মসৃণ করতে চান। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সমর্থন জিএম কাদেরের দিকেই ঝুঁকে আছে। অর্থাৎ এরশাদের অবর্তমানে জাপা আবার ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে সেই আলামত দেখছেন অনেকে।

এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তবে জাপার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে যেমন ছিলেন এখনো তেমনই রয়েছেন। তখনো সকাল বিকেল রদবদল করতেন। একটি জোকস চালু ছিল, মন্ত্রিসভার সদস্যরা সকালে বের হওয়ার পূর্বে দেখে নিতেন তার পদ আছে কি না। এখন নেতারা তেমনি ভয়ের মধ্যে থাকেন। সকলেই এটাকে এরশাদের প্রাইভেট কোম্পানি মনে করেন।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর