রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব প্রকট

আওয়ামী লীগ, রাজনীতি

হাসান আদিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট, রাজশাহী, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 11:50:42

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন প্রকাশ্যে। নেতাকর্মীদের মুখে মুখে জেলা কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আছাদুজ্জামান আসাদের দ্বন্দ্বের সারসংক্ষেপ। কমিটির শীর্ষ দুই নেতার দ্বন্দ্বে প্রায় দেড় বছর ধরে জেলা কমিটির কোনো বর্ধিত সভাও হয়নি। ফলে ভেঙে পড়েছে দলীয় শৃঙ্খলা। চেইন অব কমান্ড না থাকায় কোনো নেতাই কাউকে মানছেন না। সুবিধা পেতে যে যার মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন -এমন অভিযোগের ছড়াছড়ি।

জানা যায়, প্রায় নয় বছর পর ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে সভাপতি ও আছাদুজ্জামান আসাদকে সাধারণ সম্পাদক করে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের তিন বছর মেয়াদী কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। দলের প্রায় সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। ফলে দুই নেতার অনুসারীরাও বিভক্ত হয়ে পড়ে।

দীর্ঘদিনের এই টানাপোড়েনের মাত্রা ছাড়িয়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর। সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ পদত্যাগ করবেন জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। যা গত দুই/তিন ধরে রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন দলের বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে আওয়ামী লীগে কোন্দল সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

এদিকে, সাধারণ সম্পাদক আসাদ ফেসবুক পোস্টে সভাপতি ওমর ফারুকের অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদাহরণ, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপর সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠ। তবে দলে হাইব্রিড বলে পরিচিতদের নির্যাতনসহ নানাবিধ সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন।

রাজশাহী আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ সম্পাদক আসাদের এমন ফেসবুক স্ট্যাটাস চরম আভ্যন্তরীণ কোন্দলেরই বহিঃপ্রকাশ। এলাকাভিত্তিক সাংসদের আধিপত্য থাকার কারণে অনেকটাই উপজেলা ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সাংসদের পছন্দের লোকদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যেকার দ্বন্দ্বই প্রধান।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর শনিবার (৩১ মার্চ) রাতে বার্তা২৪.কম-এর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ফেসবুক পোস্টের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করা হলে তিনি বলেন, 'গত ১৫ মাস ধরে জেলা কমিটির কোনো মিটিং হয়নি। জেলার সভাপতিকে অসংখ্য বার বলার পরও তিনি জেলা কমিটির সভা করেননি। কেন্দ্রে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। উপজেলা নির্বাচনে দলের লোকদেরই পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী উপজেলা নির্বাচনে তার (সভাপতি ওমর ফারুকের) পছন্দের প্রার্থীর বাইরে ভোট করতে গিয়ে জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমি দেখেছি- বিএনপি জামায়াতের হাতে রক্তাক্ত অনেক নেতাকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে নিয়ে যেতে। যার সবটাই সভাপতি মহোদয় করিয়েছেন।'

আসাদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'বিএনপির সময়ও আমার নেতাকর্মীকে কেউ এভাবে জেলে দিতে পারেনি। অথচ এখন আমার নেতাকর্মীদের জেলে পাঠানো হচ্ছে। তাদের ওপর নির্যাতন করা হলেও কোনো প্রতিকার করা যায় না। নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে এসে দুঃখের কথা জানায়, কিন্তু সেগুলোর কোনো সমাধান করতে পারি না। নিজেকে এমন অসহায় এর আগে আর কখনো মনে হয়নি। তাই সরে যাওয়ার চিন্তা করছি।'

উদাহরণ তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, 'সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল মজিদের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। দুর্গাপুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাহার আলী ও উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, পৌর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান মজনু, ঝালুকা ইউপি চেয়ারম্যান মোজাহার আলীসহ মোট ১২ নেতাকর্মীকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের আগে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদের কোনো অপরাধ ছিল না। তারা উপজেলা নির্বাচনে একজন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছিল-এই তাদের অপরাধ।'

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দাবি, জেলা কমিটিকে কিছু না জানিয়ে তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী ও গোদাগাড়ীর সভাপতি বদিউজ্জামানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। উপজেলা কার্যনির্বাহী কমিটির কোনো সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়নি, এলাকার এমপির নির্দেশে এটা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর মোবাইলে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তাকে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো প্রতিউত্তর মেলেনি। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অনিল কুমার সরকার বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'তাদের (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) মধ্যে কিছুটা গ্যাপ আছে। তবে দল হিসেবে আমরা সুসংগঠিত।'

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'রাজনীতিতে অবশ্যই প্রত্যাশার জায়গা থাকে। সেটা পূরণ না হলে অভিমানের সৃষ্টি হয়। আমি মনে করছি- আসাদ অভিমান থেকে এমনটি করেছেন। তার রাজনীতি ছাড়াটা সমাধান নয়। প্রতিবাদ করতে হবে রাজনীতিতে থেকেই। পলায়নপর মনোভাব নিয়ে তো তার কোনো সমাধান হয় না। রাজনীতিতে ধৈর্যধারণ করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।'

'যেহেতু দ্বন্দ্বের কারণে পদত্যাগ করার কথাটি উঠেছে, অবশ্যই কেন্দ্রীয় কমিটি বিষয়টির সুরাহা করবে। সেসময় পর্যন্ত ধৈর্য ধরা উচিত হবে আসাদের' বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুল খালেকের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর