নেতাদের কারণেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে খালেদার কারাবাস

বিএনপি, রাজনীতি

শিহাবুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-26 07:49:21

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় মোট ১৭ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে বিগত ১৫ মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

এ দুই মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে আরও ৩৫টি মামলা। এর মধ্যে চারটিতে জামিন পাননি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ফলে মুক্তি মিলছে না তার।

বিএনপি নেতাদের সঠিক নেতৃত্বের অভাব ও কৌশল নির্ধারণ না করে পথ চলাতেই খালেদা জিয়ার কারাভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে মনে করেন খোদ দলের অনেক নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

বিএনপির অনেক নেতা ও আইনজীবী মনে করেন, খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে কারাগারে আটকে রেখেছে। অপরদিকে, রাজপথে কঠোর আন্দোলন না করায় খালেদা জিয়ার জামিন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে নিম্ন ও উচ্চ আদালতের ওপর সরকার সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়, যদি সরকারের সদিচ্ছা না থাকে।

খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল, অবরোধের মতো কঠোর কোনো আন্দোলনের পথে যায়নি দলটি। মানববন্ধন, অনশন, প্রতিবাদী সমাবেশ বা জনসভার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ খালেদার মুক্তির দাবি। যা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতাই।

মাস খানেক আগে রাজনীতির মাঠে গুঞ্জন ছিল, খালেদা জিয়ার মুক্তির সমঝোতায় বিএনপির নির্বাচিতদের সংসদে পাঠিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সে ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারেনি বিএনপি। সংসদে যাওয়ার আগে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে শর্ত সাপেক্ষে বিএনপি নেতারা সংসদে যেতেন, তাহলে খালেদা জিয়ার জামিনে সরকার বাধা দিত না।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপিতে খুব বেশি উদ্বিগ্নতা আছে বলে আমার মনে হয় না। সংসদে যাওয়া নিয়েও তারা ঠিক মতো খেলতে পারল না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার পর শর্ত সাপেক্ষে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটাও করা হয়নি। যেভাবে খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের সমর্থন রয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়ালেও লোক ছুটে আসত। কারণ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়া। তার মুক্তির প্রশ্নে বিএনপির নেতৃত্ব আরও ডায়নামিক, শক্তিশালী ও গতিশীল হওয়া দরকার ছিল।

খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারার দায় বিএনপির নেতাদেরই-এ মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি মনে করেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে কোনো আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি তাদের দল। ফলে খালেদা জিয়ার কারাভোগ দীর্ঘ হচ্ছে।

তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের নেত্রীর জন্য যে মুভমেন্ট (আন্দোলন) দরকার, তা তো আমরা করিনি। তাহলে এ দায় কি বিএনপির নেতৃত্বের দিকে যায় না?

প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি বা আমরা তো এ দায় থেকে মুক্ত না। সবাই মিলেই, এখানে এককভাবে কারো ওপরে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। আমাদের নেত্রী গণতন্ত্রের জন্য ফার্মগেট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত মশাল হাতে মিছিল করেছেন। সেই নেত্রীর জন্য যে আন্দোলন করা দরকার, সেটা আমরা করিনি। আর আমাদের শুধু মুখের কথায় বা কান্নাকাটিতে সরকার তাকে ছেড়ে দেবে, এটা আমরা ভাবি কীভাবে? নেত্রীকে মুক্ত করার জন্য আমরা প্রতিদিনই শপথ নিচ্ছি, কিন্তু সেই শপথ আমরাই ভঙ্গ করি, রক্ষা করি না। রক্ত দেব বলি, কিন্তু কেউ রক্ত দিয়েছে?

খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বের করতে না পারার দায় বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের ওপরই দিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনিও ভেবেছিলেন, বিএনপি সংসদে গেলে সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে নমনীয় হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আন্দোলনের ডাকও দেয়নি বিএনপি। রাজপথে বিএনপির কঠোর আন্দোলন না থাকা এবং সরকারের বাধা থাকায় খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।

আদালতে খালেদা জিয়া, ফাইল ফটো

 

খন্দকার মাহবুব হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, কেউ যদি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হন, তারপরও তাকে জামিন দেওয়া হয়। অথচ খালাদা জিয়ার সাত বছরের সাজায় জামিন মিলছে না। আমরা একটি মামলায় জামিন নিলে আরেকটি সামনে নিয়ে আসা হয়। আমরা জজ কোর্টে জামিন নিলে তারা (সরকার পক্ষ) হাইকোর্টে যায়, হাইকোর্ট জামিন দিলে, তারা আপিল বিভাগে যায় জামিন বাতিল করার জন্য। এভাবে খালদা জিয়ার জামিন দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যে কোনো কারণেই হোক আমাদের (বিএনপি নেতাদের) যা করণীয় ছিল, তা করতে পারিনি। রাজপথে আন্দোলন করা দরকার ছিল, সেটা করতেও বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির যেসব নেতা বিজয়ী হয়েছেন তাদের সংসদে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে কোনো বার্তা ছিল কি না জানতে চাইলে সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, আমরা ধারণা করেছিলাম যে সমঝোতার ভিত্তিতে সংসদে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি ভিন্ন চিত্র। সংসদে যাওয়ার পর হাইকোর্টে আমরা খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করেছিলাম, সেটার কাগজ আনা ও আপিলের শুনানির জন্য দুই মাস পর তারিখ দেওয়া হয়েছে। এতে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, যারা সংসদে গিয়েছেন তারা ব্যক্তি স্বার্থে গিয়েছেন। কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে বলে মনে করি না।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর