সংসদে জাপার ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ তৃণমূল

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-30 22:18:40

জনকল্যাণমূলক কোনো কর্মসূচি না দেওয়া এবং সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতারা। পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের মুখের ওপর অনেক শক্ত কথাই শুনিয়ে দিলেন তারা।

তবে প্রায় সবাই আশাবাদী যে জাতীয় পার্টি (জাপা) এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি, জাপার জনপ্রিয়তা রয়েছে। শুধুমাত্র কর্মসূচি না থাকা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে অনেকটা বেহাল অবস্থা। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সংসদে সরকারের অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং জাতীয়, স্থানীয় ইস্যুতে কর্মসূচি দেওয়ার জোর দাবি জানান জাতীয় পার্টির রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌরসভার নেতারা।

মঙ্গলবার (২৫ জুন) রাজধানীর এজিবি কলোনি কমিউনিটি সেন্টারে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সভায় ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি পার্টির জন্য নানা সুপারিশ তুলে ধরেন তারা। কেউ কেউ জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতেও ছাড়েননি।

পাবনা জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক কদর আলী মঞ্চে বসা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় মহাসচিব, আমাদের সংসদ সদস্য সংখ্যা মাত্র ২৬ জন হলো কেন? মহাজোট থেকে এতো কম আসন পেলাম কেন? আপনি জেলার নেতাদের কোনো খবর রাখেন? আপনার কাছে কতজনের ফোন নম্বর আছে?’

ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রাজি স্বপন বলেন, ‘কেন্দ্রের কোনো কর্মসূচি নেই, কোনো দিক নির্দেশনা নেই। আজ ঢাকায় আসার ব্যাপারে হতাশ নেতারা। কর্মীদের কথা হচ্ছে, তারা মনে করেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দালালি করছে। দালালি করতে হলে সরাসরি আওয়ামী লীগের দালালি করব। জাতীয় পার্টি করব কেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জোট করলাম, সংসদ তাদের ছেড়ে দিলে উপজেলা তো আমরা পেতে পারতাম। আমরা কেন পেলাম না? আমাদের নতুন কর্মী তৈরি হচ্ছে না। সম্ভবত আমরাই শেষ প্রজন্ম। আমাদের ছাত্র সংগঠন শক্তিশালী না থাকায় নতুন কর্মী তৈরি হচ্ছে না। এভাবে চললে জাতীয় পার্টি বিলীন হয়ে যাবে।’

‘সংসদে সরকারি দলের চেয়ে জাতীয় পার্টির (বিরোধী দল) সংসদ সদস্যরা উন্নয়নের কথা বেশি বলেন। এটা করলে চলবে না। বিএনপির মাত্র ছয়জন সদস্য সংসদ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের সংসদ সদস্যরা পারছেন না কেন? বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশ, তাদের আমাদের করে নিতে পারতাম। আমার সে পথে হাঁটছি না। এভাবে পার্টিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়,’ যোগ করেন তিনি।

গাইবান্ধা জেলার সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন শাহীন বলেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমার ২৩০টি আসনে আওয়ামী লীগকে ওয়ার্কওভার দিয়েছি। কিন্তু আমি জনসভা করতে গেলে ওসি ফোন করে নিষেধ করেন। গোবিন্দগঞ্জের প্রার্থীকে এক রকম হুমকি দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। জাপার দুর্গ বৃহত্তর রংপুরে কেন মাত্র ছয়টি আসন। কর্মসূচি দেন, আগামীতে বৃহত্তর রংপুরের ২২ আসনে জাপার প্রার্থীরা জয়ী হবেন। সংসদে আমাদের ২৬ সদস্য বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

পঞ্চগড় জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক বলেন, ‘জাতীয় পার্টির শিরদাঁড়া শক্ত করতে হবে। আমরা জাতীয় পার্টির জন্য জীবন যৌবন, অর্থ, মেধা সবই শেষ করলাম। পার্টির কাছ থেকে কিছুই পেলাম না। আমরা কী চাই, সেটাও নেতারা বুঝতে চেষ্টা করেন না। আমাদের অবস্থা ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলান অবস্থার মতো। পঞ্চগড় জেলা জাতীয় পার্টি সব সময় বঞ্চিত, আজও সবার শেষের টেবিলে স্থান দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণ নেতাকর্মীরা হতাশ, আজকের এই সভায় কিছুটা আশান্বিত হলো। আপনারা কর্মসূচি দেন, জেলা, জাতীয় ও আঞ্চলিক ইস্যু নিয়ে কথা বলেন, মানুষ গ্রহণ করবে। আমি বলেছিলাম, যতদিন এরশাদ বেঁচে আছেন, তার সঙ্গে আছি। আমি এখন ক্লান্ত।’

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খাইরুল আলম বলেন, ‘জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সংসদে যথাযথ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করুন। মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষুব্ধ। আমাদের ভূমিকা ভালো হলে, মানুষ আমাদের গ্রহণ করবে। কেন্দ্রের কোনো নির্দেশনা গ্রামে যাচ্ছে না। এভাবে দলকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।’

কুড়িগ্রাম জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সেন্ট্রাল ঠিক করেন। আমরা তৃণমূল ঠিক আছি। আমরা ট্রেনের বগিতে আছি, বগি ফেলে দিয়েন না। আমি ভোটের সময় দেখেছি, একজন বয়স্ক লোক আমাকে বললেন, একটু আগে ফোনে এরশাদ স্যারের সঙ্গে কথা হলো। পার্টির চেয়ারম্যান তৃণমূলের লোকজনের নাম জানেন। এটা বড়ো যোগ্যতা।’

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা জাপার সদস্য সচিব আব্দুল জলিল বলেন, ‘এক বছর পর চিঠি দিয়ে ডেকে আনেন। অন্য সময় কোনো খোঁজ খবর নেন না। সব জেলায় সাংগঠনিক কর্মসূচি দেন। বিভাগে বিভাগে সাংগঠনিক টিম থাকতে পারে।’

বোচাগঞ্জ উপজেলা জাপার সভাপতি জুলফিকার হোসেন বলেন, ‘আজকের সাংগঠনিক সভার শুরুর প্রথমে সাংগঠনিক প্রতিবেদন থাকা উচিত ছিল। প্রতিবেদন থাকলে আমরা বুঝতে পারতাম, আমাদের সংঠনের অবস্থা কী। আমাদের পার্টিতে নির্বাচনের ১৫ দিন আগে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। আগামী নির্বাচনের জন্য এখনই প্রার্থী মনোনীত করে তাকে মাঠে নামিয়ে দিতে হবে।’

এজন্য সাংগঠনিক টিম পাঠিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে চূড়ান্ত করতে হবে। সাংগঠনিক টিমকে যেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রভাবিত করতে না পারেন। পদ দিয়ে লাভ নেই। কর্মসূচি দেন, আমাদের কাজ দেন, পার্টি ঘুরে দাঁড়াবে। বিএনপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই সময়ে আমরা এগিয়ে গেলে জনগণ আমাদের কাতারে এসে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।

এ সময় মাইক নিয়ে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা আট বিভাগে আটটি সাংগঠনিক টিম গঠনের চিন্তা করছি। কেউ বলেছেন স্ব-স্ব বিভাগ থেকে টিম করার জন্য, কেউ বলছেন বাইরে থেকে করার জন্য। আপনারা এ বিষয়ে মতামত দিতে পারেন, কোনটা হলে ভালো হয়।’

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নূর আলম যাদু বলেন, ‘আমাদের আসনটি জাপার দুর্গ। গত সংসদ নির্বাচনে এ আসন আওয়ামী লীগকে দেওয়া হয়েছে। উপজেলাও যদি দিয়ে দেন, তাহলে দল কীভাবে চলবে। সংসদ সদস্য দিয়েছেন। উপজেলা যদি নিতেন তাহলে দল বেঁচে থাকত। জাতীয় পার্টি সঙ্গে না থাকলে এতিম হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ।’

বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের আসনে আলতাফ আলীকে ২০১৪ সালে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি পার্টির কোনো খোঁজ খবর নেননি। ২০১৭ সালে পার্টির চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম। তখন পার্টির চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে ওকে বহিষ্কার করতাম। বিগত নির্বাচনে আমিনুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু একদিন পর হঠাৎ মনোনয়ন বদলে যায়। এভাবে খামখেয়ালীপনা করলে দল চলবে কী করে?’

মোহনপুর উপজেলা জাপার নেতা আমিনুল হক বলেন, ‘সঠিক নেতৃত্বের অভাবে জাপা ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন, যারা কাজ করতে দেন না। পার্টিতে বিভাজন সৃষ্টি করেন, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

লালমনিরহাট সদর জাতীয় পার্টির সভাপতি আকবর ইমাম বলেন, ‘খোঁজ না নিয়ে অচেনা অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়াই পরাজয়ের মূল কারণ। আগামীতে আগে ভাগেই প্রার্থীদের নামিয়ে দিতে হবে।’

প্রেসিডিয়াম সদস্য গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলন করে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে পারছে না। জাতীয় পার্টি কিন্তু তার চেয়ারম্যানকে ঠিকই জেল থেকে মুক্ত করেছে। এটা রেকর্ড। বিএনপি এবার মাত্র ছয়টি আসন পেয়েছে। আর আমরা ২২ আসনে জিতেছি। এটাও কিন্তু বাস্তবতা। সাংগঠনিক শক্তি ধরে রাখতে না পারলে উপযোগিতা থাকবে না।’

অনেক নেতাই অভিযোগ করেন, যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে। তাতে তারা নজেহাল হচ্ছেন, মান সম্মান হারাচ্ছেন, অর্থ খরচ হচ্ছে। রাতের আঁধারে ভোট কারচুপি ঠেকাতে সোচ্চার হতে হবে।

বেলা ১১টায় শুরু হওয়া এ সাংগঠনিক সভার শুরুতে জিএম কাদের বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবার কথা শুনতে চাই। সে কারণে সবাই তিন মিনিটের মধ্যে বক্তব্য শেষ করতে পারলে ভালো। আপনারা যতক্ষণ কথা বলতে চান, আমি ততক্ষণ আছি। প্রয়োজন হলে বিকেল পর‌্যন্ত সভা চলবে।’

জিএম কাদেরের এ বক্তব্যের প্রতিফলন পাওয়া যায় কাজেও। সবার বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শোনেন। কিছু কিছু নোটও করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কখনোই এত দীর্ঘ সময় ধরে পার্টির নেতাদের বক্তব্য শোনেননি। আক্ষেপ ঝাড়তে পেরে নেতাকর্মীরা বেশ উৎফুল্ল। বুধ ও বৃহস্পতিবার একই স্থানে পৃথক চার বিভাগের সাংগঠনিক সভা অনুষ্ঠিত হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর