জিএম কাদের আত্মঘাতী পথে হাঁটছেন!

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-26 00:53:12

নভেম্বরের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ ৫১ জেলা ও মহানগর কমিটির সম্মেলন করতে চায় জাতীয় পার্টি। এ সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের জন্য অত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

দ্রুততম সময়ে কমিটি গঠন করতে গিয়ে কিছু ভুল ত্রুটি থেকে যেতেই পারে। এতে জেলায় জেলায় নতুন করে গ্রুপিং সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের যাদের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সক্ষমতা নিয়েও রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। যাদের বিভাগীয় কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা অনেকেই সে সব জেলার ত্যাগী নেতাকর্মীদের বিষয়ে অবগত নন। সে কারণে ভোট ছাড়া কমিটি গঠনে স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

আর এমনটি হলে বঞ্চিতরা স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে জট পাকানোর চেষ্টা করতে পারেন। সারাদেশে এতগুলো জেলা ও মহানগরে গ্রুপিং সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। আর এ জটিল পরিস্থিতি এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির প্রথম সম্মেলনকেও প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। যেখানে বড় একটি গ্রুপ মন থেকে জিএম কাদেরকে সহ্য করতে পারছে না। তারা এ জটে তেল-সলতে যুগিয়ে পাকিয়ে তুলতে পারেন।

আর যদি জট পাকাতে সফল হন, রওশনকেও প্রভাবিত করার সক্ষমতা রাখেন তারা। ইতোপূর্বে তারা তাদের সেই সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। জিএম কাদের যখন চেয়ারম্যান হলেন, তখন রওশন এরশাদকে প্রভাবিত করে তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আবার বিরোধী দলীয় নেতার প্রশ্নে জিএম কাদেরের সরাসরি বিরোধীতা করেন।

জিএম কাদেরের চিঠি বাতিল করে রওশনকে বিরোধী দলীয় নেতা করার জন্য পাল্টা চিঠি দিয়েছিলেন স্পিকারকে। এমনকি রওশন এরশাদকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণাও দিয়েছিল কাদের বিরোধী ওই গ্রুপটি। পরে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার মধ্যস্থতায় সে যাত্রায় ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় জাতীয় পার্টি।

সিনিয়র অনেক নেতা জানিয়েছেন, রওশন এরশাদ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নন, তার সন্তান রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পার্টির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চান। যাতে পরবর্তীকালে সাদ এরশাদের পথচলা নিষ্কন্টক হয়। তিনি কখনোই চাইবেন না, জিএম কাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হোক। এ কারণেও গোপনে সলতে জোগাতে পারেন রওশন।

জেলায় জেলায় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে কাদের বিরোধীদের হাত শক্তিশালী করা হচ্ছে না তো- এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা মনে করছেন, এতো তড়িঘড়ি করে এতগুলো জেলায় কাউন্সিল করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কমিটি গঠনে জিএম কাদের প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা না রাখতে পারলে খারাপ কিছু হতে পারে।

বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে গত ২০ আগস্ট। শুরু থেকেই দফায় দফায় রদবদল ও সংযোজনে সংকটে রয়েছে টিমগুলো। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় দু’দিন আগেই গত হয়েছে। মাত্র দু’টি জেলায় আংশিক সম্মেলন হয়েছে। ময়মনসিংহ, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের টিম এখনও সরেজমিন যেতেই পারেনি। হাতে থাকা ২৮ দিনের মধ্যে সব সম্মেলন শেষের লক্ষ্যকে আকাশ-কুসুম কল্পনা মনে করছেন অনেকে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সিলেট বিভাগীয় টিমের সদস্য সচিব সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে যতটা সম্ভব জেলার সম্মেলন শেষ করার চেষ্টা চলছে। যেগুলো শেষ করা যাবে না, সেখানে হয় আহ্বায়ক কমিটি, না হলে পুরনো কমিটির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে।

সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সম্মেলন করায় দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং বাড়তে পারে কি না জানতে চাইলে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার বলেন, আমি মনে করি কোনো গ্রুপিং তৈরি হবে না। বেশিরভাগ জেলায় পুরনো মুখ থাকছে।

জাতীয় পার্টির জেলা ও মহানগরের ৭৫ কমিটির মধ্যে ৫১ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। নয় বছর আগে মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে এমন জেলা কমিটিও এখন বিদ্যমান। আবার এমনও অনেক জেলা রয়েছে, যেখানে সম্মেলন হয়েছে কয়েক বছর আগে, কিন্তু কমিটি গঠন করা যায়নি।

সবচেয়ে নাজুক অবস্থা রাজধানীর সবচেয়ে নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের কমিটির। ২০১২ সালের আগস্টে মেয়াদ শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই এ কমিটির। একই সময়ে শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির মেয়াদও। ঢাকার পার্শ্ববর্তী আরেক জেলা গাজীপুরের অবস্থাও নাজুক। এ জেলার আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ও শোডাউনের ক্ষেত্রে এসব জেলার ওপর নির্ভরশীল থাকে। স্বল্প সময় ও স্বল্প খরচে লোকজন এনে জমায়েত বাড়ানো সম্ভব হয়। সেই জেলাগুলোর বেহাল অবস্থা জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির।

ঢাকা বিভাগের চার মহানগর ও ১২ জেলা কমিটির মধ্যে ১১ কমিটির মেয়াদ শেষ। সবার আগে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে জাতীয় পার্টি সবচেয়ে ভাগ্যবান কেন্দ্রীয় নেতা মজিবুল হক চন্নুর জেলা কিশোরগঞ্জের। তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতার উষ্ণতা ভোগ করেছেন। এখনও করে যাচ্ছেন। চুন্নুর জেলা কিশোরগঞ্জের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে। নয় বছর পেরিয়ে গেলেও কাউন্সিল করা হয়নি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে জেলা জাপার কার্যক্রম। এ নেতাকেই দেওয়া হয়েছে জাপার দুর্গ রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের দায়িত্ব। এখনও পর্যন্ত কোনো খবরই নেই। সরেজমিন যাওয়া তো দূরের কথা, একটি মিটিংও করতে পারেননি এ পর্যন্ত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর