বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমে হতাশ জাপার তৃণমূল

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-23 14:54:05

লক্ষ্য ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ ৫০ জেলা ও মহানগর কমিটির কাউন্সিল করা হবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। যেখানে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না, সেখানে আহ্বায়ক কমিটি কিংবা চলমান কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু লক্ষ্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি জাতীয় পার্টি। নির্ধারিত সময়ে শুধুমাত্র মাদারীপুর জেলায় কাউন্সিল হয়েছে। ওই জেলায় সভাপতি-সম্পাদক মনোনীত করা হয়েছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা যায়নি। এর বাইরে খুলনা মহানগর কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সফলতা বলতে গেলে এটুকুই। এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে।

এতে করে ডিসেম্বরে কাউন্সিল নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রোববার (১ ডিসেম্বর) বসছে জাতীয় পার্টির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের সভা। এ সভাতেই কাউন্সিলের ভাগ্য চূড়ান্ত হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, কাউন্সিল ডিসেম্বরে হতেই হবে। কারণ কেন্দ্রীয় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা এখন গ্রেস পিরিয়ডে আছি। নতুন করে সময় চাইলে নির্বাচন কমিশন হয়তো নাও দিতে পারে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, বিধায় কাউন্সিল করতেই হবে। আমরা নির্ধারিত তারিখে কাউন্সিল করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

৫০ জেলা ও মহানগর কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর আগে যখন কাউন্সিল হয়েছে, তখন আরও খারাপ অবস্থা ছিল। আমাদের গঠনতন্ত্রে প্রভিশন রয়েছে, যতদিন নতুন কমিটি না হবে, ততদিন আগের কমিটি বহাল থাকবে। সে কারণে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হতে কোনো গঠনতান্ত্রিক বাঁধা নেই।

জাতীয় পার্টির ৭৬ কমিটির (জেলা ও মহানগর) মধ্যে ৫০ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। নয় বছর আগে মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে এমন জেলা কমিটিও এখন বিদ্যমান। আবার এমন অনেক জেলা রয়েছে, যেখানে সম্মেলন হয়েছে কয়েক বছর আগে কিন্তু কমিটি গঠন করা যায়নি। নাজুক অবস্থা রাজধানীর নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের কমিটির। ২০১২ সালের আগস্টে মেয়াদ শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই এ কমিটির। একই সময়ে শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির মেয়াদও।

ঢাকার পার্শ্ববর্তী আরেক জেলা গাজীপুরের অবস্থাও নাজুক। এ জেলার আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ও শোডাউনের ক্ষেত্রে এসব জেলার ওপর নির্ভরশীল থাকে। স্বল্প সময় ও স্বল্প খরচে লোকজন এনে জমায়েত বাড়ানো সম্ভব হয়। সেই জেলাগুলোতে বেহাল অবস্থা জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির।

ঢাকা বিভাগের চার মহানগর ও ১২ জেলা কমিটির মধ্যে ১১টির মেয়াদ শেষ। বলা হয়, রাজধানীতে যে দলের ভিত যত মজবুত, সেই পার্টি রাজনীতির ক্ষেত্রে ততবেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিক সভায় বলেছিলেন, শুধু ঢাকায় আন্দোলনের কারণে আমাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু সেই ঢাকা বিভাগে জাপার সাংগঠনিক অবস্থা অনেকদিন ধরেই নড়বড়ে।

সবার আগে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে জাতীয় পার্টির সবচেয়ে ভাগ্যবান নেতা মজিবুল হক চন্নুর জেলা কিশোরগঞ্জের। তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতার উষ্ণতা ভোগ করেছেন। এখনও করে যাচ্ছেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য চুন্নুর জেলা কিশোরগঞ্জের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে। নয় বছর পেরিয়ে গেলেও কাউন্সিল করা হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জেলা জাপার কার্যক্রম।

বলতে গেলে বিভাগ ভিত্তিক সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সিলেট বিভাগের। রংপুরের পরে সিলেটকে বলা হয় জাতীয় পার্টির জন্য দ্বিতীয় উর্বরক্ষেত্র। এখানে জাতীয় পার্টির অনেক রিজার্ভ ভোট রয়েছে। এ বিভাগের প্রার্থীরা প্রত্যেক নির্বাচনেই ভালো ফল পেয়েছেন। সিলেট মহানগর ও চার জেলা কমিটির সবক’টির মেয়াদ শেষ বলা যায়।

২০১৪ সালে শেষ হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ। ২০১৭ সালের ৯০ দিনের সময় দিয়ে গঠন করা হয়েছিল সিলেট জেলার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। সেখানেই আটকে আছে শাহজালালের পুণ্যভূমি সিলেট জেলা জাপার কার্যক্রম। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন হয়েছে ২০১৮ সালের আগস্টে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও কমিটি গঠন করা যায়নি। ঝুলে রয়েছে কমিটি গঠনের কার্যক্রম।

জাতীয় পার্টির ঘাটি হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগের অবস্থাও বেহাল বলা যেতে পারে। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের ওই নিজ বিভাগের এক মহানগর ও আট জেলা কমিটির মধ্যে পাঁচটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কমিটি গঠন করা যায়নি। খোদ চেয়ারম্যানের নির্বাচনী আসন লালমনিরহাট জেলার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ১৩ মাস আগে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলা কমিটির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ১৬ মাস আগে রংপুর মহানগর কমিটির সম্মেলন হয়েছে। এখনও কমিটি জমা পড়েনি দফতরে।

জাপার ঘাটি খ্যাত এ বিভাগের সাংগঠনিক টিমের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ। এখনো তারা সরেজমিন যেতে পারেননি। বলা চলে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এ বিভাগের সাংগঠনিক টিমের প্রধান করা হয়েছে প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুকে। যার নিজের জেলাতেই কমিটি নেই ২০১০ সাল থেকে। যে কারণে তার সফলতা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।

পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সংসদীয় দলের নেতা রওশন এরশাদের নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহ বিভাগেও সাংগঠনিক অবস্থা বেহাল। এ বিভাগের শুধু নেত্রকোনা জেলা কমিটির মেয়াদ রয়েছে। অন্য তিন জেলার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের কার্যক্রম নিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। কথিত রয়েছে শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়েই নিষ্ক্রিয় সাংগঠনিক টিমও।

রাজশাহী বিভাগের আট জেলা কমিটির মধ্যে ছয় জেলার মেয়াদ শেষ। ২০১৬ সালে বগুড়া জেলা কমিটির সম্মেলন হলেও এখনো কমিটি গঠন হয়নি। কেন্দ্রেও কমিটি জমা হয়নি। মুখে মুখে যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছেন, সেই পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ দেখেননি কমিটির কাগজ। এরশাদ বেঁচে থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। বিভাগের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও নাটোর কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।

তবে এ বিভাগের সাংগঠনিক টিম বেশিরভাগ জেলা সফর করে কর্মীদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রত্যেকটি জেলায় প্রতিনিধি সম্মেলন শেষ করেছেন। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির কাউন্সিল কিংবা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করার ক্ষেত্রে এখনও সফলতার মুখ দেখতে পাননি।

খুলনা বিভাগের মহানগর ও চার জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা ও এক মহানগর কমিটির মধ্যে শুধুমাত্র বরগুনা ও পিরোজপুর জেলা কমিটির মেয়াদ রয়েছে। ২০১৭ সালেই গত হয়েছে অনেক কমিটির মেয়াদ। সম্প্রতি খুলনা মহানগর কমিটি ভেঙ্গে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের জাপার অবস্থাও খারাপ। এ বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে আট জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ। কুমিল্লা মহানগর কমিটি গঠনই করা হয়নি। পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে মেয়াদ শেষ হয়েছে লক্ষীপুর জেলা কমিটির। অথচ এ বিভাগের নেতা জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু তখন ছিলেন পার্টির মহাসচিবের দায়িত্বে।

জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সভায় নেতাকর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে পৃথক বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল, টিমগুলো জেলায় জেলায় সফর করে তৃণমূলকে চাঙ্গা করবে। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো আপডেট করবে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থী এবং জাপার জন্য উর্বর আসনগুলো চিহ্নিত করবে। কিন্তু অনেক টিম সরেজমিন যেতে ব্যর্থ হয়েছে।

সাংগঠনিক টিমগুলোর মেয়াদ বেধে দেওয়া হয়েছিল ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। ওই সময়ে অগ্রগতি হতাশজনক হলে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। তারপরও কাজ শেষ হয়নি। ফলে রাজশাহী বিভাগ ছাড়া অন্যান্য বিভাগের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, সাংগঠনিক টিমগুলো অনেক ভালো কাজ করেছে। তাদের মুভমেন্টের কারণে আমরা জানতে পারছি জেলাগুলোর অবস্থা। দুই মাসের মধ্যে সব জেলায় কাউন্সিল করা সম্ভব নয়। অনেকটা ট্রাকে উঠে এসেছে। এটাকে ম্যাক্সিমাম মনে করছি। কিছু একটা হয়েছে, এটাই বা কম কিসে?

এ সম্পর্কিত আরও খবর