জাপার গঠনতন্ত্র আরও একনায়কতান্ত্রিক

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 01:03:20

জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র আরও বেশি একনায়কতান্ত্রিক হয়ে গেলো দলটির ৯ম জাতীয় কাউন্সিলের পর। পার্টির চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে গুরুতর নানান বিষয় তার খেয়াল-খুশির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

দলীয় গুরুতর অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অন্যদের কিছুই বলার থাকছে না। এমনকি পার্টির চেয়ারম্যান ছাড়া অন্যান্য পদে নির্বাচনের পথও অনেকটা রোহিত করা হয়েছে। চেয়ারম্যান যাকে খুশি যেকোনো পদে পদায়ন করতে পারবেন।

৯ম জাতীয় কাউন্সিলে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র কাটাছেঁড়া করে যা দাঁড়িয়েছে তার সারাংশটা এমনই হচ্ছে। বেশির ভাগ ধারা-উপধারায় ‘চেয়ারম্যান মনে করিলে’ বাক্যটি যুক্ত করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ধারা ১২-এর ৩ উপধারায় বলা হয়েছে—‘অথবা কাউন্সিলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হইবার পর তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য সকল পদে নিয়োগদান করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইবে’।

এতদিনও বিষয়টি এমনই হয়ে এসেছে অলিখিতভাবে। তবে কাউন্সিলে কণ্ঠভোটে চেয়ারম্যানের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হতো। যার ভিত্তিতে চেয়ারম্যান কমিটি গঠন করতেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলেও এই সংস্কৃতি বিদ্যমান। কিন্তু জাপা গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে বিষয়টি লিখিতভাবে চেয়ারম্যানের এখতিয়ারভুক্ত করেছে।

আবার কেন্দ্রীয় কমিটির আকারের ক্ষেত্রেও কোনো ধরাবাঁধা থাকছে না। পার্টির চেয়ারম্যান যতোখুশি সদস্য অনর্ভুক্ত করতে পারবেন। ধারা-১২ এর ৩ উপধারা সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘ইহা ব্যতীত পার্টির চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় সদস্য অন্তর্ভুক্ত করিতে পারিবেন’।

ধারা ২০ এর ১(চ) উপধারার সংশোধনীতেও উপদেষ্টামন্ডলী গঠনের ক্ষেত্রে আগের সীমা ১৫ থেকে বাড়িয়ে চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘সর্বোচ্চ পনের সদস্য বিশিষ্ট’ শব্দাবলী বিলুপ্ত হইবে এবং তদস্থলে ‘প্রয়োজনমতো’ শব্দটি যুক্ত হইবে।

ধারা ২০এর ২(ক) উপধারার সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান পার্টিতে চেয়ারম্যানের পরের মর্যাদায় অনধিক ৭ জন কো-চেয়ারম্যান এবং প্রয়োজনে মহাসচিবের পরের পদমর্যাদায় প্রেসিডিয়ামের মধ্য হতে যে কাউকে ৮ বিভাগের জন্য অনধিক ৮ জনকে অতিরিক্ত মহাসচিব নিয়োগ করিতে পারিবেন। কো-চেয়ারম্যানগন পদাধিকার বলে প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসেবে গণ্য হইবেন’। এখানে অতিরিক্ত মহাসচিবের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া না দেওয়া চেয়ারম্যানের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ধারা ২(গ) এ বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান প্রয়োজন মনে করিলে জাতীয় ও দলীয় জরুরি প্রয়োজনে কো-চেয়ারম্যানবৃন্দ, মহাসচিব এবং অতিরিক্ত মহাসচিববৃন্দকে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিবেন। যাহা পরবর্তীতে প্রেসিডিয়ামের সভায় অনুমোদন করানো হইবে’।

আবার স্ববিরোধী ধারাও বিদ্যমান গঠনতন্ত্রে। ধারা-২০ এর সংশোধনী এনে উপধারা-১ যুক্ত করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক: জাতীয় পার্টিতে একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকিবেন। তিনি পার্টির সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হইবেন। পার্টির কোনো সভায় তিনি উপস্থিত থাকিলে চেয়ারম্যানের ওপরে তাহার স্থান হইবে। জাতীয় ও দলীয় যোকোনো বিষয়ে প্রয়োজন মনে করিলে চেয়ারম্যান তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিবেন’।

আবার উপধারা ১(১) এ বলা হয়েছে পার্টির চেয়ারম্যান, ‘পার্টির প্রেসিডিয়ামের সভায় সভাপতিত্ব করিবেন’। ওই বৈঠকে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের মর্যাদার কী হবে তা পরিস্কার করে কিছুই বলা হয়নি। প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের পরামর্শ গ্রহণের বিষয়টিও চেয়ারম্যান মনমর্জির ওপর নির্ভরশীল করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র সংশোধন উপ-কমিটির আহ্বায়ক সুনীল শুভরায় বার্তা২৪.কমকে বলেন, এটাই জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পার্টির নেতাকর্মীরাই তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছেন।

এতে পার্টির চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতা বাড়তে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সুনীল শুভরায় বলেন, না, তা হবে কেন? উনি যা করবেন দলের মঙ্গলের জন্যই করবেন।

এরশাদের মৃত্যূর পর পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে জিএম কাদের বলে আসছেন, এই পার্টির মালিক হবেন নেতাকর্মীরা সকলে। এখানে কারো একক মালিকানা থাকবে না। আমরা একেকজন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করছি। এরচেয়ে বেশি কিছু না। কিন্তু পার্টির গঠনতন্ত্রে তার একচ্ছত্র ক্ষমতা অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না।

নতুন করে এসব সংশোধনী নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। প্রকাশ্য কিছু না বললেও অনেকে চেয়ারম্যানের অভিসন্ধি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, হয়তো রওশন এরশাদকে ঠেকাতে এভাবে পদে পদে জিএম কাদেরকে নিরষ্কুশ ক্ষমতাবান করা হয়েছে।

এটি ভালো হলে ভালো, না হলে মহাখারাপ হতে পারে। এরশাদের সেই ৩৯ ধারা ২০১৬ সালের কাউন্সিলে সংশোধনীতে ২০/১/ক ধারার চোটে কতোজন চোখের জলে দল ছেড়েছেন। সেই ধারা এখনও বিদ্যমান। তার ওপর নতুন করে ক্ষমতবান। নিরষ্কুশ ক্ষমতা জিএম কাদের যদি কান কথা শুনে প্রয়োগ করেন তাহলে পার্টি ভালোর চেয়ে খারাপ ডেকে আনতে পারে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু ঘটনা কান কথা শ্রবণের নজির সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর