পঁয়ত্রিশে পা রাখলো জাতীয় পার্টি

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-30 22:05:02

পঁয়ত্রিশ বছরে পা রাখলো জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলের ঐক্য ধরে রাখা এবং প্রকৃত বিরোধী দল হয়ে ওঠাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে দলটি। ১৯৮৫ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিলো। সেই ফ্রন্ট বিলুপ্ত করে ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল আত্মপ্রকাশ করে।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন অধ্যাপক এম এ মতিন। ২১ প্রেসিডিয়ামসহ নির্বাহী কমিটির আকার ছিল ৬০১ জন। জোটের শরিক জনদল, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি, বিএনপি (শাহ),মুসলিম লীগ (সা) ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন সেদিন জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। কথিতরয়েছে কাউকে কাউকে যোগদানে বাধ্য করা হয়েছিল তখন।

জাতীয় পার্টির মতো আর কোন রাজনৈতিক দল এত দফায় দফায় ভাঙনের শিকার হয়নি। জাতীয় পার্টিথেকে বের হয়ে গিয়ে প্রথম পৃথক জাতীয় পার্টি (মিম) গঠন করেন মিজানুর রহমান ও আনোয়ারহোসেন মঞ্জু। দ্বিতীয় দফায় ভাঙনের শিকার হয় নাজিউর রহমান মঞ্জু ও কাজী ফিরোজ রশীদেরনেতৃত্বে। সর্বশেষ পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন প্রয়াত কাজী জাফর আহমদ। বর্তমানে জাতীয়পার্টির— জাতীয় পার্টি (জাপা), জেপি, বিজেপি ও জাতীয় পার্টি (জাফর) নামে ৪টি ধারা বিদ্যমান।

চার খণ্ডিত অংশের মধ্যে জাতীয় পার্টি (জাপা) এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীনজোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অপর দুই অংশ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও জাতীয় পার্টি (জাফর) বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে যুক্ত।

বিগত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। জোটথেকে ২৬টি আসন দেওয়া হয়। আর ১৪৬টি আসন রাখা হয় উন্মুক্ত। জোটগত আসনে ২১টি, উন্মুক্ত ১টিসহ ২২টি আসনে বিজয়ী হন এরশাদের প্রার্থীরা। সংসদে জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৪টি। মোট ২৬ আসন নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।

অনেকে মনে করেছিলেন এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি ভেঙে টুকরো টুকরো হবে। কিন্তু তাদেরসেই ভবিষ্যত বাণী অসার প্রমাণিত হয়েছে। এরশাদের মৃত্যুর পর পার্টির হাল ধরেছেন তারসহোদর প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ কাদের। বিভাগীয় সাংগঠনিক সভা, সাংগঠনিক টিম গঠন ও জেলায় জেলায় সভা সমাবেশের মাধ্যমে ক্ষেত্র বিশেষে জাতীয় পার্টিকে এখন আরও বেশি উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।

জিএম কাদের একাধিক সভায় বলেছেন, জাতীয় পার্টির এখন ক্ষয়িষ্ণু দল নয়। জাতীয় পার্টি এখনবর্ধিষ্ণু দল। মানুষ মনে করেছিল এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি ভেঙে টুকরো টুকরো হবে।কিন্তু তা হয়নি, বরং ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

অনেক শঙ্কা থাকলেও ২৮ ডিসেম্বর সফলভাবেই কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। কাউন্সিলে প্রধান পৃষ্ঠপোষক, পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। এরইমধ্যে কো-চেয়ারম্যানও অতিরিক্ত মহাসচিবদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য ফরম বিতরণশুরু হয়েছে।

এরশাদের মৃত্যূর পর পার্টিতে ভাটার টান লক্ষ্যণীয় হলেও কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দলটি। এতদিন যারা জিএম কাদেরের ছায়াও মাড়াতেন না সেই সব সিনিয়র নেতাদেরএখন হরহামেশা দেখা যাচ্ছে বনানী অফিসে। এমনকি এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থাতেও যারা পার্টির কর্মসূচি অনেকটা এড়িয়ে চলতেন তারাও এখন সরব। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জাপার নেতাকর্মীরা।যদিও কেউ কেউ তাদের হঠাৎ সরবকে সন্দেহের চোখেই দেখতে চাইছেন। তারা মনে করছেন নতুন করেকোনো ফন্দি আটছেন না তো তারা!

তবে শঙ্কার কথা হচ্ছে রওশন এরশাদের নিরবতা। পার্টির কাউন্সিলে উপস্থিত হননি তিনি। তারঅনুপস্থিতিতেই গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে তাকে (রওশন) প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়েছে। এইঘোষণার পর এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি রওশন। তিনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেনসেটাই এখন বড় বিষয়।

যদিও পার্টির তৃণমূলে তার সমর্থন ভগ্নাংশের নিচে। সিনিয়র কিছু সভাসদ ছিলেন তারাও এখনজিএম কাদেরের তীরে তরী ভিড়িয়েছেন। সমর্থন থাকুক আর নাই থাকুক, রওশন বেঁকে বসলে গোলবাঁধতে পারে। বিশেষ করে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে টানা-হেঁচড়া হতে পারে।

কারণ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে টানা-হেঁচড়ার সময় হাইকোর্ট রওশনের নামেই লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ করেছিলেন। ২০১৪ সালে এরশাদকে চ্যালেঞ্জ করে সামনে এসেছিল বিষয়টি। ওই সময়ে রওশনবিরোধী দলীয় নেতা হওয়ার পর এরশাদের সঙ্গে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচন নিয়েমতবিরোধ দেখা দেয়। এরশাদ চেয়েছিলেন তিনি নিজে মনোনয়ন দেবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রওশনেরতালিকাই বহাল ছিল। ওই সময়ে হাইকোর্টের সেই আদেশ ইসিতে প্রদর্শন করার খবর রটেছিল।

জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র আগে থেকেই একনায়কতান্ত্রিক। গঠনতন্ত্রের নতুন সংশোধনীতে পার্টিরচেয়ারম্যান আরও বেশি ক্ষমতাবান হয়েছেন। জিএম কাদের এখন যা খুশি করতে পারবেন। এটাকেঅনেকে শঙ্কার চোখে দেখছেন। চেয়ারম্যান যদি আবেগতাড়িত কিংবা কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়েসিদ্ধান্ত নেন তাহলে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হবে।

নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যানের সামনে এখন দু’টি বড় চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছেন। একটি জাতীয় পার্টির ঐক্য ধরে রাখা, আরেকটি হচ্ছে সংসদ ও সংসদের বাইরে প্রকৃত অর্থে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা। সাধারণ জনগণ এমনকি পার্টির কর্মীরাও নিজেদের গৃহপালিত বিরোধী দল মনে করেন। এই অবস্থান থেকে বের হতে হলে কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে নয়, কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চান মাঠের কর্মসূচি। তারা মনে করেন সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলেরভূমিকা পালনের পাশাপাশি মাঠে কর্মসূচি না থাকলে জাপার রাজনীতি থাকবে না। সেটা কতটুকু সম্ভব সেটাই এখন বড় বিষয়।

আর কাউন্সিল কেন্দ্রিক যে ঐক্য তৈরি হয়েছে এটাকে ধরে রাখাও চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে।সরকারের আনুকূল্য থাকায় অনেকেই রওশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। অনেকের ধারণা,কখনও দ্বিধা দেখা দিলে রওশনই সরকারের বেশি আনুকূল্য পাবেন। বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচনেরপ্রশ্নে বিষয়টি অনেকটা প্রমাণিত। সে কারণে জিএম কাদের পার্টির যাই হোক শঙ্কা থেকেইযাচ্ছে।

তবে জিএম কাদের ইতোমধ্যে কর্মীবান্ধব খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তৃণমূলের কর্মীরাও সহজেই সাক্ষাৎ পান কিংবা কথা বলতে পারছেন। এ ক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরত্বে রয়েছেন রওশন। তৃণমূলের কর্মী থাকলো দূরের কথা সিনিয়র নেতাদেরও বেশ বেগ পেতে হয় তার সাক্ষাৎ পেতে।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টি ভোটের সমীকরণেও দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। আসন সংখ্যায় কিছুটা হেরফের হলেও ভোটের সূচক সব সময় নিম্নগামী। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে কাস্টিং ভোটের ১১.৯২ শতাংশ পেয়েছিলো জাতীয় পার্টি। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১০.৬৭শতাংশ, আর ২০০১ সালের ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট পায়৭.২৫ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ৭.০৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন অংশ নেয়। কিন্তু যে আসনেই জোট ছাড়া নির্বাচন করেছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়েছেন দলটির প্রার্থীরা।

জাতীয় পার্টির দুর্গ খ্যাত রংপুর ও গাইবান্ধা থেকেও দিন দিন গুটিয়ে যাচ্ছে দলটি। রংপুর বিভাগের ২২ আসনের মধ্যে মাত্র ৬টি আসনে রয়েছে জাপার এমপি। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলও আশাব্যঞ্জক নয়। মাত্র একটি উপজেলায় জাপার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর