কমিটি গঠন নিয়ে জাপায় হতাশার ঢেউ

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 05:32:40

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। হতাশার ঢেউ কেন্দ্র থেকে জেলা ঘুরে উপজেলায় গিয়ে আছড়ে পড়ছে।

জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় দলে গুণগত পরিবর্তনের আশায় যারা বুক বেঁধেছিলেন সবচেয়ে বেশি হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মাঝেই। যারা এরশাদের ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’-এ অভিমানে নিষ্কিয় ছিলেন তারাও সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন জি এম কাদের দায়িত্ব পাওয়ার পর।

তারা আশা করেছিলেন— এবার অন্তত এরশাদের আশপাশে থাকা চাটুকারদের দৌরাত্ম কমে যাবে। স্টাফদের খবরদারি কমে যাবে, মূল্যায়িত হবেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। কিন্তু অল্পদিনের মাথায় তাদের আশা ফিকে হতে শুরু করেছে। শুধু কিছু মুখের পরিবর্তন হয়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে নতুন কিছু মুখ জুটেছে।

অল্প কয়েকজন লোক এমনভাবে মহীরূহ হয়ে উঠেছেন, তারাই এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তায় পরিণত হয়েছেন। তাদের আজ্ঞাবহদের এখন সর্বত্র জয়জয়কার। এতদিন যারা কর্মী ছিলেন, তাদের নিয়ে বসানো হয়েছে নেতাদের উপরে। কর্মী থেকে হঠাৎ করে নেতা বনে যাওয়া এসব নেতাদের পিছনে কাজ করতে বিব্রত বোধ করছেন পুরনো নেতারা। এলাকায় কোন অবস্থান নেই, সংগঠন নেই, শুধু কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চেহারা দেখিয়ে বড় বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন অনেকেই।

ছাত্র সমাজ, যুব সমাজের অনেক সাবেক নেতাই অনেক দিন ধরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। কারো কারো মেয়াদ পনের-বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। তাদের সদস্য পদেই রাখা হয়েছে। আর ছাত্র সমাজের সদ্য বিদায়ী কমিটির নেতাদের সরাসরি সম্পাদকমণ্ডলীতে পদায়ন করা হয়েছে।

ছাত্র সমাজের সদস্য বিদায়ী কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জামাল উদ্দিন, তাকে জাতীয় পার্টির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। একই কমিটির সদস্য সচিবকে করা হয়েছে যুগ্ম ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক, অলিউল্লাহ মাসুদকে করা হয়েছে সাংগঠনিক সম্পাদক।

আর কোনো রাজনৈতিক দলে সদ্যবিদায়ী ছাত্র নেতাদের এভাবে মূল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বানানোর রেকর্ড নেই। ছাত্র সমাজের পর যুব সমাজ, এরপর স্বেচ্ছাসেবক পার্টি ঘুরে মূল সংগঠনে প্রবেশের রেওয়াজ ছিল। কিন্তু সব রেওয়াজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তরুণদের এমন নেতৃত্বে আনার বিষয়টি ইতিবাচক হতে পারতো যদি পার্টির যুব সংগঠন না থাকতো।

জাতীয় পার্টির বিভাগীয় সাংগঠনিক সভায় অন্যতম দাবি ছিলো— এক নেতার এক পদ। পার্টির চেয়ারম্যান ওই সভায় সহমত প্রকাশ করে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কিছুই মানা হয়নি। একই ব্যক্তিকে চারটি পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন বলা চলে।

আবার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের প্রায় সবাইকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। জাতীয় কৃষক পার্টির সভাপতি সাইদুর রহমান টেপা একাধারে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব। কৃষক পার্টির সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। মহিলা পার্টির সেক্রেটারি নাজমা আক্তার একইসঙ্গে প্রেসিডিয়ামের সদস্য ও ফেনী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি। স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন খোকা প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন।

এই প্রমোশনের খেলায় পিছিয়ে নেই থানার নেতারাও। শাহবাগ থানা জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি ইব্রাহিম আজাদ একই সঙ্গে মহানগর দক্ষিণ জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি ছিলেন। তাকে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষ্টি বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। তার মতো ঢাকা মহানগরের অনেক থানার নেতাকেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। যারা একাধারে থানা, মহানগর ও কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেয়েছেন।

পার্টিতে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছে সেইসব নেতাকর্মীরা যারা জিএম কাদেরের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এ কারণে অনেকেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। রাজশাহী মহানগরে গণপদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহী মহানগরের পদত্যাগী নেতারা লিখিত চিঠিতে পার্টির চেয়ারম্যানের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

রাজশাহী মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ডালিম তার পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, “আমি দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে জাতীয় পার্টির সাথে যুক্ত রয়েছি। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ স্যারের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হওয়া, ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করা, সাংগঠনিক অদক্ষতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে সকল পদ-পদবী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বর্তমান চেয়ারম্যানের আশেপাশে যারা আছেন তারা অর্থ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অযোগ্যদের পদায়ন করে পার্টির ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করছেন।”

সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে দুজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। পার্টির চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এক নেতা কয়েক মাসের ব্যবধানে ৩ দফায় প্রমোশন পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। একবার প্রমোশনের ৪ দিনের মাথায় দ্বিতীয় প্রমোশন পেয়ে নিজেকে জানান দিয়েছেন।

ফেসবুক ঘাটলেই চোখে পড়বে জাপা কর্মীদের হতাশা ও ক্ষোভ। অনেকে ফেসবুক লাইভে এসে নিজের ক্ষোভ জানিয়ে জাপাকে গুডবাই জানাচ্ছেন। গুঞ্জন রয়েছে রাজশাহী মহানগরের পর আরও অনেক জেলা উপজেলার নেতারা গণপদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অনেক সিনিয়র নেতা নাকি রওশন এরশাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন কো-চেয়ারম্যানও রয়েছেন। যারা রওশনকে পার্টির হাল ধরার জন্য অনুরোধ করেছেন। রওশনও নাকি জিএম কাদেরের এসব কর্মকাণ্ডে অনেকটা ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে চিঠি দিলেও ছেলেসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান না দেওয়ার বিষয়টি সহজভাবে নেননি তিনি।

সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর লজ্জাজনক ফল কর্মীদের আরও হতাশ করেছে। ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ ভোটারের ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলের আসনে থাকা জাপার লাঙল প্রতীক পেয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৫শ’ ৯৩ ভোট। গণফ্রন্টের চেয়েও কম ভোট পেয়েছে জাপার মেয়র প্রার্থী, আর কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন মাত্র ১ জন। এখানে পার্টির শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা হয়েছে।

এসব ব্যাপারে জানতে বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর