একটি ‘ফুটবলীয়’ ডিভোর্স!

ফুটবল, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 08:41:36

দড়ি টানাটানি দেখেছেন?

মেসি এবং বার্সা এখন সেই লড়াইয়ে নেমেছেন! কেউ জিততে পারছে না। কেবল বেচারা দড়ির সুতো ঢিলে হচ্ছে। ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে শক্তি হারানোর আতঙ্ক স্পষ্ট। ক্রমশ সঙ্কুচিত মর্যাদা। চারধারে দাঁড়ানো অনেকেই উদ্বিগ্ন। অনেকেই আবার চূড়ান্ত ‘খেল’ দেখার অপেক্ষায় চকচকে চোখে।

মেসি-বার্সার এই লড়াই দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ সেলিব্রেটি কোনো দম্পতি ডিভোর্সের জন্য লড়ছেন! আইন-আদালত, উকিল-আইনজীবী; দুই পক্ষের প্রতিটি নাড়াচাড়া টিভি, অনলাইনে লাল অক্ষরে ব্রেকিং নিউজের ব্যানার!

আসলে তো ডিভোর্সই বটে! ফুটবলীয় একটা ডিভোর্সের লড়াই দেখছে গোটা বিশ্ব। বার্সার সঙ্গে মেসির ২০ বছরের সম্পর্ক চুকানোর লড়াই। অথচ এই তো মাত্র কিছুদিন আগেও এই জুটিকে কি আদর্শই না বলা হতো?

প্রসঙ্গ উঠলেই বার্সা জানাতো মেসি তার ক্যারিয়ার শুরু করেছেন লা মেসিয়ায়। শেষও হবে তার ন্যু ক্যাম্পেই। মেসিও অমন আশ্বাসই দিতেন। মাঝে এক-আধবার সামান্য মন কষাকষি হলেও মেসি কখনো বার্সা ছেড়ে দেবেন, অথবা মেসিকালেই মেসিকে ছাড়া বার্সা খেলবে- এমন সম্পর্কচ্ছেদের কথা কোনো পক্ষই যে ভাবেনি!

কি যে সুখী দিনকাল ছিল বার্সা ও মেসির!

- কি পায়নি বার্সা, মেসিকালে?

এক অর্থে সব কিছুই পেয়েছে। যে ১৬ মৌসুমে মেসি খেলেছেন, তাতে ৩৪টি ট্রফি জিতেছে বার্সা। এর মধ্যে ২৪টি ঘরোয়া চ্যাম্পিয়ন ট্রফি আর ১০টি আন্তর্জাতিক। যার প্রতিটির সাফল্যে আছে মেসির শ্রম- মেধা আর ঘামের চিহ্ন! বার্সার হয়ে সব মিলিয়ে ৭৩১ ম্যাচে ৬৩৪ গোল। ছয়বার মেসির জেতা ব্যালন ডি’অর দেখে বার্সাও গর্বিত হয়েছে- ‘ওটা তো আমাদেরই!’

-বার্সাও কি কোনো কিছু কম করেছে মেসির জন্য?

যখন যা পারিশ্রমিক চেয়েছেন মেসি, তাই দিয়েছে বার্সা। পুরো দল গড়ার কর্তৃত্বও ছিল তার হাতে একসময়। অধিনায়কত্ব পেয়েছেন। সম্মান পেয়েছেন। পরিণত হতে পেরেছেন। বিশ্বের সেরা ফুটবলারকে গড়েছে বার্সা।

অথচ আজ দুজনার দুটো পথ দুদিকে..!

কিন্তু এমন কি হওয়ার কথা ছিল?

জীবন বয়ে চলে। সবাই যে আজীবন একই ক্লাবে খেলবেন, এমন তো কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। স্বকীয়তা-স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু তাই বলে এমন বিদায়!

ক্লাবের ইতিহাসের সেরা ফুটবলারের এমন বিদায় কি কখনো কল্পনায় ছিল? মেসির সঙ্গে বার্সার এই বিচ্ছেদ তো আরও সুন্দর-সুললিত এবং আবেগপ্রবণও হতে পারতো।

একটু সেই কল্পনায় ঘুরে আসি।

বার্সার হয়ে বিদায়ী ম্যাচ খেলতে নামছেন মেসি। ন্যু ক্যাম্পের সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ আর কেউ নয়, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন আপনি- চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ। মেসির সম্মানে এই ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরাও মেসির ছবি সম্বলিত জার্সি পরে গ্যালারিতে। আর বার্সার গ্যালারি তো চিরকালীনই মেসিময়। ম্যাচ শুরুর অনেক আগে থেকেই পুরো শহরে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস। যে কোনো বিদায়ই তো বেদনার। তবে সাফল্যের ঝলমলে আলো যিনি জ্বালিয়েছেন, অসংখ্য আনন্দের ফুটবলীয় রাত যিনি উপহার দিয়েছেন, প্রায় একক কৃতিত্বে অসম্ভব অবস্থান থেকে দলকে টেনে তুলে জয় এনে দিয়েছেন; তাকে তো অবশ্যই বীরের কায়দায় বিদায় জানাতে হয়!

তাকে বিদায় জানাতে এক চোখে জল থাকবে তো অন্য চোখে আনন্দ! বার্সার সাফল্যের পেয়ালা টইটুম্বুর করে দেওয়া লিওনেল মেসির তো এমনই কৃতজ্ঞতার মোড়কেই বিদায় হওয়ারই প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল গার্ড অব অনার।

আর সেই মেসি এখন বার্সার কাছে ডিসঅনার!

মেসি মানেই বার্সা। আবার ঠিক বার্সা মানেই মেসি। ২০০৪ এ বার্সার জার্সি গায়ে মেসির পথচলার পর থেকেই এই পরিচয়ই দেখে আসছিল ফুটবল দুনিয়া। মেসি ঠিক যতখানি না আর্জেন্টিনার তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি ছিলেন বার্সেলোনা এফসির।

ছিলেন- এই শব্দ বেদনাই জানাচ্ছে মেসি এখন বার্সার অতীতের গল্প!

গোল করার পর দুই হাতের তর্জনী আকাশের দিকে উঁচিয়ে মেসির আনন্দ-উল্লাস আর কৃতিত্বের সিংহভাগ গল্প-গাথার সঙ্গী বার্সেলোনা। আবার কোনো ম্যাচ শেষে ক্যামেরা যখন জুম করতো মেসির মুষড়ে পড়া মুখের ওপর- সেই বিষণ্নতাই জানান দিতো এই ম্যাচ বার্সা জিততে পারেনি।

এভাবেই বার্সেলোনার আনন্দ-বেদনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন মেসি। অথচ আজ তাকেই অবিশ্বাস করছে বার্সা! ক্লাবের প্রতি তার ভালোবাসা আজ সন্দেহের তালিকায়।

বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির ক্যারিয়ার কাহিনীর এমন শেষাংশ ভীষণ কষ্টের। ট্র্যাজিক! বার্সার সমর্থকরা মেসিকে ফুটবল ঈশ্বরের মর্যাদা দিয়েছিল। এখন বার্সার সঙ্গে ফুটবল ঈশ্বরের বন্ধুত্বের সম্পর্কচ্ছেদে সেটা ‘নষ্ট ভালোবাসা’!

সুন্দর সম্পর্কের কুৎসিত সমাপ্তি- এই নষ্ট কাহিনীর মূল রচয়িতা কে; মেসি নাকি বার্সা? সেটা সমর্থকদের তর্কের বিষয়। হয়তো দল ছাড়ার চলতি জটিলতা মিটিয়ে মেসি ও বার্সা একসময় সবকিছু মেনে নিয়ে একে অন্যকে ধন্যবাদও জানাবে। আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পর এক সময়ের স্বামী-স্ত্রীও লোকাচার এবং সামাজিকতায় যেমন সুশীল আচরণ করে থাকেন, তেমনই আরকি!

তবে একটা বিষয় পরিষ্কার-বিচ্ছেদ মানেই ব্যবধান। সেটা যেমন বিয়েতে, তেমনই খেলায়ও!

এ সম্পর্কিত আরও খবর