দিয়োগো ম্যারাডোনা: আর্জেন্টিনার ট্র্যাজিক ফুটবল আইকন

, খেলা

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 13:00:57

চোখ-ধাঁধানো, কুখ্যাতি, অসাধারণ, বিরল প্রতিভা, বিতর্ক- এই সবের সংমিশ্রণ দিয়োগো ম্যারাডোনা। তিনি ছিলেন ফুটবলের এক আইকন, কিন্তু নানা দোষে যুক্ত। ফুটবলের অনন্য প্রতিভাধর ও বিচক্ষণ খেলোয়াড়। অলৌকিকতা, দূরদৃষ্টি, চমৎকারিত্ব এবং ক্ষিপ্র গতি, খেলায় কখন কি ঘটতে পারে তা আগে থেকে বুঝে ফেলার ক্ষমতা- এমন বিরল সংমিশ্রণ গোটা বিশ্বের ভক্তদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি ম্যারাডোনা।

তার বিতর্কিত ‘ঈশ্বরের হাতে গোল’ করে যেমন নিন্দিত হয়েছিলেন, তেমননি ভক্তরা ভালোবেসেছিলেন। এবং মাদককাণ্ড ও ব্যক্তিগত নানা বিষয়ে নিজেকে বিতর্কিত করে তুলেছিলেন এই কিংবদন্তী।

৬০ বছর আগে আর্জেন্টিনার বুইয়েন এইরেসের শান্টি শহরে জন্ম দিয়াগো ম্যারাডোনার জন্ম। দরিদ্র পরিবার থেকে ফুটবলের সুপার স্টার হয়েছিলেন তিনি।

‘ঈশ্বরের হাতে গোল’

অনেক তাকে ব্রাজিলের কিংবদন্তী ফুটবলার পেলের থেকে প্রতিভাবান মনে করেন। এক জরিপে পেলেকে পেছনে ফেলে 'বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম ফুটবলার' হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। পরে অবশ্য ফিফা পেলে ও ম্যারাডোনা সম্মান দিতে সেই নিয়ম পাল্টায়।

ম্যারাডোনা অল্প বয়স থেকেই চমকপ্রদ নৈপূণ্য দেখিয়ে লস সেবোলিটাস যুব দলকে ১৩৬ ম্যাচে টানা অপরাজিত থাকার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন ম্যারাডোনা।

বেটে এবং গাঁট্টাগোট্টা, উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি; শারীরিক গঠনে ঠিক অন্যান্য অ্যাথলেটদের মতো ছিলেন না। তবে তার দক্ষতা, নৈপূণ্য, দৃষ্টি, বল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, ড্রিবলিং করা এবং গতি তার ওজন সমস্যার থেকে বেশি আলোচিত হয়েছে।

তার নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্ব জেতে আর্জেন্টিনা

ম্যারাডোনার উত্থান-পতনের ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪টি গোল করেছেন; যাকে একটি গল্পই বলা যায়। তার নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্ব জেতে আর্জেন্টিনা। এর চার বছর পর আবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে নেন তিনি।

ছিয়াশির বিশ্বকাপের সেই কোয়ার্টার ফাইনাল এমনিতেই ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। সে সময়ে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তাপ ম্যাচটিকে এমনিতেই তাতিয়ে রেখেছিল। ফুটবল ম্যাচ নয়, যেন যুদ্ধের উত্তাপ। ৫১ মিনিট গোল শূন্য থাকার পর ম্যারাডোনা বিপক্ষ গোলরক্ষক পিটার শিল্টনের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জালে বল খোঁচা দিয়ে গোল করে ম্যারাডোনা। এই গোল নিয়েই যত বিতর্ক।

পরে নিজেই সেই গোলের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ঈশ্বরই তার হাত দিয়ে গোলটা করিয়ে নিয়েছেন! উত্তর ছিল এমন, ‘ম্যারাডোনার খানিকটা মাথা আর ঈশ্বরের খানিকটা হাত, এ দিয়েই গোল!’

ম্যারাডোনার উত্থান-পতনের ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪টি গোল করেছেন

অবশ্য ওই বিতর্কিত ওই গোলের চার মিনিট পর তার দ্বিতীয় গোলটি আসে। সেটি ছিল অনন্য, অসাধারণ। বেশ কয়েকজন খোলোয়াড় ও গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে তিনি জালে বল জড়ান। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তার এই গোল দুর্দান্ত ও সত্যিকারের ফুটবল প্রতিভা বলে মন্তব্য করেন।

ম্যারাডোনা দু'বার ক্লাব পরিবর্তনে রেকর্ডটি করেছিলেন- ১৯৮২ সালে বোকা জুনিয়র্সকে ছেড়ে স্প্যানিস ক্লাব বার্সেলোনায় যান ৩ মিলিয়ন পাউন্ডে। এর দুই বছর পর ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ইতালির ক্লাব নেপোলিতে যোগ দেন ম্যারাডোনা।

১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয়। শুধু তাই নয় ১৯৮৭ সালে কোপা ইতালিয়াও জিতে নাপোলি। এছাড়া ১৯৮৯ সালে রানারআপ হয়। নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনা ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।

এক সময় কোকেনের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েন ম্যারাডোনা। ওই সময় ক্রাইম সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। বিচিত্র এক মানুষের নাম দিয়েগো ম্যারাডোনা। বলা হয়ে থাকে বিতর্ক আর ম্যারাডোনা হাত ধরাধরি করে চলতেন। ১৯৯০ সাল সন্তানের পিতৃত্ব সংক্রান্ত মামলায় জরিমানা হয় তার।

এক সময় কোকেনের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েন ম্যারাডোনা

ইতালিতে অনুষ্ঠিত ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-০ ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পরের বছর ডোপ টেস্টে পজেটিভ আসায় ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞার দেওয়া হয় তাকে। এরপর ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট বিশ্ব তার জীবনের সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। ডোপ টেস্টে ধরা পড়ায় বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ করে ফিফা। এরপর তার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপের তিন বছর পর আবারও ড্রোপ টেস্টে পজেটিভ আসায়  অবসর নেন ফুটবলের এ জাদুকর। তবে পুরো জীবনে বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি।

ড্রাগ রাখার দায়ে ২ বছর জেল খাটতে হয়েছিলো ম্যারাডোনাকে। এমনকি সাংবাদিকদের দিকে গুলি ছুড়ে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনা।

মদপান ও কোকেনের অভ্যাসের কারণে তার স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়। স্থূলতা সমস্যা দেখা দেয়, এক পর্যায়ে ১২৮ কেজি ওজন হয় তার। ২০০৪ সালে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। ওজন কমাতে সার্জারি করেছিলেন তিনি। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি লাভের আশায় কিউবাতে নিরাময় কেন্দ্রে ছিলেন।

এত বিতর্কের পরও ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ঘোষণা করে ডিসেম্বর ২০১০ থেকে আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ম্যারাডোনা।আর্জেন্টিনা ওইবার কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নেয়।

একবার তার পোষা কুকুর তাকে কামড়ে দেয়ায় তার ঠোঁট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নতুন করে বানাতে হয়েছিল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর