ফুটবলার আঁখির পরিবারের স্বপ্ন পূরণ

ফুটবল, খেলা

সুজন সরকার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিরাজগঞ্জ | 2023-09-01 21:03:47

সিরাজগঞ্জের মেয়ে নারী ফুটবলার আঁখি এখন জেলার সকলের নয়নের মনি। নানা অভাবে বেড়ে ওঠা আঁখি এখন অনেক মেয়েরই আদর্শ। আঁখির পরিবার, বন্ধু-বান্ধবীসহ স্থানীয়রা বলছেন, আঁখিদের মতো গ্রামাঞ্চল থেকে ওঠে আসা মেয়েরাই এখন দেশের নাম ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

নারী সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ নারী ফুটবলের শিরোপা জয়ে দেশবাসীরা আনন্দিত ও উল্লসিত করছে। একই আনন্দ চলছে আঁখির জন্মভুমির বাড়িতেও। জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের আক্তার হোসেন ও নাছিমা বেগম দম্পতির দুই সন্তানের ছোট আঁখি।


শিরোপা জয়ের পর শাহজাদপুরের আঁখিসহ তার পরিবারের সদস্যরা পাচ্ছেন বাহবা। এই বাহবার পেছনে রয়েছে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ। আঁখির গ্রামে যারা অতীতে কটুকথাসহ নানা ধরনের নৈতিবাচক মন্তব্য করতেন, তারাই এখন আঁখিসহ তার পরিবারকে নিয়ে প্রশংসা করছেন জানালেন, আঁখির হাতেখড়ি দেওয়া শিক্ষক পাড়কোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মো. মনসুর রহমান।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক মনসুর রহমানের সহযোগিতায় দরিদ্র তাঁত শ্রমিক আকতার হোসেনের মেয়ে আঁখি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নারী ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করেন। প্রথমে উপজেলা, জেলা, রাজশাহী, ঢাকায়। এরপর আর থামতে হয়নি আঁখিকে। অনূর্ধ্ব ১৫ জাতীয় দলেও খেলার সুযোগ পায় আঁখি। নারী হয়ে ফুটবল খেলে বলে এক সময় গ্রামবাসী তাকে কটুকথা ও অনেক ধরনের নৈতিবাচক মন্তব্য করেছেন। সেই তারাই এখন আঁখিকে বাহবা দিচ্ছেন, প্রশংসা করছেন। কারণ আঁখি এখন বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের তারকা খেলোয়াড়। গত ডিসেম্বরে ভারতকে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল সবুজের দল। আর সে কারণেই কটুকথাকারীরা এখন প্রশংসা করছেন আঁখির।


আঁখির বড় ভাই নাজমুল ইসলাম বলেন, আমাদের সংসার এখন সুখের। আমাদের আর কোন কষ্ট নেই। আগে আমাদের অভাব ছিলো। মা মাঝে মধ্যেই আশ-পাশের বাড়িসহ নানা বাড়ি থেকে চাল-ডাল আনতো। এখন আর আনতে হয় না।

স্থানীয় আঁখির বান্ধুবি মনোয়ারা, তিশা ও উর্মি জানান, আমরা আঁখির সাথেই পড়েছি। ও ছোট বেলা থেকেই ফুটবল, দৌড় ও জাম্পিং খেলায় প্রথম হতো। আঁখি আমাদেরসহ সকলের গর্ব।

পাড়কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন হোসেন জানান, ২০১১ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নারী ফুটবল খেলা শুরু হয়। পরের বছর আঁখিকে নিয়ে দল গঠন করেন সহকর্মী মনসুর রহমান। তিনি নিজেও একজন সাবেক ফুটবলার ছিলেন।


তাঁত শ্রমিক আঁখির বাবা আকতার হোসেন জানান, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মনসুর স্যার এবং ইব্রাহিম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের লাকী ম্যাডাম আমার মেয়ে আঁখিকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দু’জন শিক্ষকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আঁখির জন্য আজ আমি গর্বিত ও সম্মানিত। প্রধানমন্ত্রী উপহার হিসেবে ১৫ লাখ দিয়েছেন। সে অর্থ দিয়ে আমি জমি কিনে চাষাবাদ করে সংসার চালাচ্ছি।

ইব্রাহিম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক কামরুন নাহার জানান, নারী ফুটবলের জয়ের পেছনে আছে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট। আঁখির উঠে আসা এই টুর্নামেন্ট দিয়েই। ২০১৪ সালে আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তির পর বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলে আঁখি। এরপরে নাম লেখায় বিকেএসপিতে। সেখান থেকে ডাক পায় ২০১৫ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ গ্রহণকারী বাংলাদেশ দলে। সেখানেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। আঁখি, পারভীন, জেসমিনসহ ১২ জনকে নিয়ে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুন নাহার লাকী নারী ফুটবল খোলোয়ারদের একটি দল গঠন করেন। ৮ জন বিকেএসপিতে সুযোগ পেলেও অন্যান্যরা ঝড়ে পড়ে। এত দারিদ্রদের মধ্যেও তাঁত শ্রমিক কন্যা আঁখি দমেনি।


জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল হাসান হিলটন জানান, নারী ফুটবলার আঁখি সিরাজগঞ্জের গর্বিত সন্তান। পুরো খেলা আমি মাঠেই দেখেছি। মুহূর্তের ভিতরে ওভারলেকিং ছাড়া লং পাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে সবসময় চাপে রেখেছিল। তার এই অসামান্য অবদানে জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা আঁখিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।

জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট আঁখির ফুটবলে হাতেখড়ি। এর পরে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায়। এখন জাতীয় দলের হয়ে খেলছে। বর্তমানে আঁখির খেলার মান অসাধারণ। সাফের শিরোপা লড়াইয়ে দেশের হয়ে অবদান রাখায় আমরা আনন্দিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে আগামীতে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর