দর্শকরা মাত্রই নড়েচড়ে বসেছে একটা জমজমাট ম্যাচ উপভোগের জন্য। প্রথম রাউন্ডে বেশ কয়েকবার থাইল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন বক্সার আনান পংখেট-কে পরাস্ত করেছেন বাংলাদেশের সুরকৃষ্ণ চাকমা। দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই অসাধারণ দক্ষতায় প্রতিপক্ষের তলপেটে পাঞ্চ। তাতেই কাবু পংখেট। ছয় রাউন্ডের ম্যাচ হলেও প্রতিপক্ষ নাস্তানাবুদ দ্বিতীয় রাউন্ডেই।
রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বলরুমে এভাবেই বাজিমাত করেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বক্সার সুরকৃষ্ণ চাকমা। লাল–সবুজের পতাকা হাতে রিংয়ে তার দীপ্ত পদচারণা মুখরিত হয়ে ওঠে দর্শকদের বাংলাদেশ–বাংলাদেশ স্লোগানে।
‘বেক্সিমকো এক্সবিসি ফাইট নাইটে’ প্রত্যাশার শতভাগ পূরণ করেছেন ২৯ বছর বয়সী দেশের উদীয়মান এই বক্সার।
এবারই প্রথম ছয় রাউন্ডের খেলায় অংশ নিয়েছেন সুরকৃষ্ণ। এ নিয়ে ছিলেন কিছুটা টেনশনেও। ‘আমি ভেবেছিলাম বক্সিং রিংয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হব। তবে যথাযথভাবে প্রতিপক্ষকে এক পাঞ্চেই ঘায়েল করতে পেরেছি। আর এই পাঞ্চ আয়ত্ব করার জন্য কয়েক হাজার বার অনুশীলন করেছি আমি, বলেন সুরকৃষ্ণ।
বক্সিংয়ে শুধু দুই হাত দিয়ে প্রতিপক্ষকে আঘাত করলেই হবে না, মানসিকভাবেও নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এ বিষয়ে সুরকৃষ্ণ বলেন, ‘আমার ফিলিপাইনি কোচ মানসিক প্রস্তুতিটা ভালোভাবেই রপ্ত করিয়েছেন। আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই —এই জেদ ও ইচ্ছেটা তিনিই আমার মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন। এখন আমার লক্ষ্য আট রাউন্ডের বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া।’
সুরকৃষ্ণ চাকমার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠার গল্পটা ছিল সংগ্রামময়। গ্রামের অন্য কিশোরের মতো তিনিও ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়েই মেতে ছিলেন। তবে বড় হয়ে ফুটবলার বা ক্রিকেটার নয়, ভিন্নধর্মী খেলা বক্সিং নিয়ে এক নতুন পথ তৈরি করে চলেছেন তিনি। পেশাদার বক্সিংয়ে ইতিমধ্যে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের পেশাদার বক্সার সুরকৃষ্ণ চাকমা সাউথ এশিয়ান প্রো বক্সিং চ্যাম্পিয়ন।
কেন বেছে নিলেন বক্সিং? সুরকৃষ্ণ বলেন, ‘২০০৭ সালে আমি যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হই, তখন ফুটবলের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। ছোটবেলায় রাঙামাটিতে ফুটবল খেলতাম। খেলাধুলা মানেই বুঝতাম ফুটবল বা ক্রিকেট। বক্সিং সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। বিকেএসপিতে ফুটবলে চেষ্টা করে যখন সুযোগ পাইনি তখন বক্সিংয়ে আসলাম। ফুটবলের পাশাপশি মার্শাল আর্টও আমাকে টানত। তাই বক্সিংকেই ভালোবাসতে শুরু করে দিই।’
বিশ্বখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলি তার পছন্দের এবং অনুপ্রেরণার নাম। বাংলাদেশের পেশাদার বক্সিংয়ের যাত্রাপথ মসৃণ নয়। তবু অনুপ্রেরণায়, স্বপ্নে, প্রচেষ্টায় ভিন্নধর্মী এই খেলায় বিকশিত হয়ে উঠছেন একটু একটু করে। মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের ব্র্যান্ড এনডোর্সার হয়েছেন তিনি।
বিকাশের চিফ মার্কেটিং অফিসার মীর নওবত আলী বলেন, সুর কৃষ্ণ চাকমা একজন অসাধারণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়। প্রচেষ্টা আর সাধনায় তিনি পেশাদার বক্সিং এর জগতে নিজের এবং বাংলাদেশের নাম লিখিয়েছেন। তার অর্জনের ঝুলিতে ইতিমধ্যে যোগ হয়েছে অনেক অর্জন। সামনের দিনে সুর এর প্রতিভা বিকাশ এর সুযোগ তৈরি করতে আমরা তার সাথে যুক্ত হয়েছি। বাংলাদেশের কোটি মানুষের দৈনন্দিন লেনদেন সহজ ও নিরাপদ করে তাদের জীবন উন্নয়নে কাজ করছে বিকাশ। সুর তার পথচলায় বিকাশ ব্যবহারে পেয়েছেন স্বাচছন্দ্য। তার খেলার জগতেকেও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলতেই আমাদের এই যৌথ পথ চলা ।
এমনই বড়–ছোট নানান উদ্যোগে বিশ্ব বক্সিংয়ে বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন সুরকৃষ্ণ।
এরই মাঝে তার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক পেশাদার বক্সিং সাউথ এশিয়ান প্রফেশনাল বক্সিং ফাইট নাইট—দ্য আল্টিমেট গ্লোরি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। সুরকৃষ্ণ চাকমা প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক পেশাদার বক্সিংয়ে বাংলাদেশের হয়ে স্বর্ণপদক জয় করেছেন।
বাংলাদেশে পেশাদার বক্সিংয়ের চর্চা ছিল না, সুরকৃষ্ণ চাকমাকে দিয়ে সেটার শুরু। সুযোগটা কীভাবে এল? সুরকৃষ্ণ জানান, ২০১৪ সালে এসএ গেমসে সোনাজয়ী বক্সার আবদুর রহিমকে হারিয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। এরপর কমনওয়েলথ গেমসের দলে ডাক পান। ২০১৫ সালে লন্ডন থেকে আসেন কিক-বক্সিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আলী জ্যাকো। তিনি ফেডারেশনে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করেন। শেষ পর্যন্ত সুরকৃষ্ণ একাই সুযোগ পান এবং লন্ডনে যান। লন্ডনে বিখ্যাত পিকক জিমে ছয় মাস অনুশীলন করেছেন তিনি। পেশাদার বক্সার হওয়ার ভিতটা তখনই মজবুত হয়। নামকরা অনেক বক্সার আসতেন সেখানে। সবাই তাঁকে দেখে উৎসাহ দিতেন। এরপর ২০১৮ সালে সুরকৃষ্ণকে পাঠানো হয় ভারতে। হরিয়ানার একটা একাডেমিতে ছয় মাস অনুশীলন করেন তিনি। বক্সিং ফাউন্ডেশনের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে এমন একটা ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং টুর্নামেন্ট হবে। সেই টুর্নামেন্টে সুরকৃষ্ণ তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।
এই সংগ্রামময় যাত্রায় পরিবারের সহাযোগিতা কেমন পেয়েছেন? সুরকৃষ্ণ বলেন, আমার বাবা খেলোয়াড় ছিলেন। তাই খেলাধুলা নিয়ে কোনো বাধা ছিল না। ছোটবেলাতেই বাবা মারা যাওয়ার আমার পরিবার আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নয়। মা, মামা, কাকা মিলে তাই আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তি করে দেন। বিকেএসপির খরচ, পরিবারের খরচ—সবকিছু মামারাই দিয়েছেন।
খেলাধুলার পাশাপাশি সংগ্রামী সুরকৃষ্ণ চাকমা পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন নিজের আগ্রহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি।