বত্রিশে সাকিব, শুভ জন্মদিন

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-17 23:39:55

শুভ জন্মদিন সাকিব আল হাসান।

আজ ফেসবুক, ফ্যানপেজ, ইনবক্স বা সাকিবের সেলফোনের ম্যাসেজের ঘর, ভরে যাবে এই শুভেচ্ছা বাণীতে। বয়স ষোল হলো খুব কায়দা করে বলা হয় সুইট সিক্সটিন। তাহলে ষোলোর দ্বিগুণ বত্রিশ বা থার্টি টু’কে কি বলবেন?

বত্রিশ বছরের সাকিবকে নিয়ে একটা শব্দই সবচেয়ে বেশি কার্যকর মনে হচ্ছে, পরিণত। বত্রিশের সাকিব আজ ক্রিকেট বিশ্বে পরিণত ক্রিকেটারদের মধ্যে সেরাদের একজন। সেরাদের সেরা বললেও ভুলের কিছু নয়। বিশ্বের আর কোন ক্রিকেটার তিন ফরমেটের ক্রিকেটে এতো দীর্ঘ সময় ধরে নাম্বার ওয়ান হয়েছিলেন?

উত্তর হলো, কেউ না, সাকিবই একমাত্র!

আফসোস, দুঃখ বা কষ্ট। এসব শব্দ নিয়ে বেশি ভাবেনই না সাকিব। যে আনন্দ নিয়ে খেলাটা শুরু করেছিলেন সেই উপভোগের রেশ, তীব্রতা এখন আরও বেড়েছে অনেকগুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব। হয়েছেন আরও পরিণত। এসেছে পরিমিতিবোধ। অর্জন করেছেন অনেক সাফল্যে। রেকর্ড গড়েছেন। পেয়েছেন স্বীকৃতি। আর এই যোগফলের হিসেব যখন মেলাতে বসেন তখন মনে স্বস্তি, ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি এবং বুক জুড়ে একটা আত্মবিশ্বাসের আনন্দ, নাহ ক্রিকেটীয় জীবনের আপাত সময়টা মন্দ কাটেনি।

৫৫ টেস্ট, ১৯৭ ওয়ানডে এবং ৭২ টি-টুয়েন্টি, নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রায় এক যুগের পথ পরিক্রমার ছবিকে এমনই স্বস্তির রংতুলিতে রাঙাচ্ছেন সাকিব।

টেস্ট ক্যারিয়ার তার শুরু হয়েছিলো ২০০৭ সালে। মাঝের ১১ বছরে সাকিব এই ফরমেটের ক্রিকেটে ব্যাট ও বল হাতে যা করেছেন তাতে খুব স্পষ্ট করে এখন বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের অধ্যায়কে দুইভাগে ভাগ করতে পারেন আপনি, সাকিবপূর্ব এবং সাকিবোত্তর টেস্ট যুগ!

রেকর্ড। প্রভাবশালী ক্রিকেট। ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক। চ্যালেঞ্জ জেতার অদম্য প্রাণশক্তি। শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে সামনের কাতারে থাকার মানসিক দৃঢ়তা। নিজেকে সেরাকে প্রতিদিনই ছাড়িয়ে যাওয়ার পণ, এমনসব ক্রিকেটীয় অনুষঙ্গই সাকিব আল হাসানকে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা অলরাউন্ডারদের পাশে গর্বের আসন দিয়েছে।

টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ এখনো অনেক পেছনের কাতারের দল। আর এই পেছনের সারির দলের একজন যখন ব্যক্তিগত পারফরমেন্সে পুরো বিশ্বকে ছাড়িয়ে যান। ছাপিয়ে যান। তখন বুঝতেই হবে এই ‘এককের’ মূল্য অপরিসীম।

সাকিব আমাদের কাছে তেমনই রত্ন। 

মানছি র‌্যাঙ্কিং বা পরিসংখ্যান ক্রিকেট শ্রেষ্ঠত্বের শেষকথা নয়। তবে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে যখন একজন ক্রিকেটার অনেক লম্বা সময় ধরে বিশ্বসেরা হওয়ার মর্যাদা পান, তখন অবশ্যই বুঝে নিতে হবে এই ‘হীরের’ মূল্য কোহিনুর সমান।

সাকিব আমাদের কাছে ক্রিকেটের সেই তাজ।

অথচ তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল একেবারে সাদামাটা ভঙ্গিতেই। মামুলি শুরুটা দেখে কেউই বলেনি যে সেদিনের এই ছেলেটা এতদূর যাবে। তার শুরুর কয়েক টেস্টের ব্যর্থতা দেখে সাবেক এক অধিনায়কের মন্তব্যটা আজো স্পষ্টত মনে আছে, 'সাকিব বোধহয় এখনি টেস্ট ম্যাচের জন্য তৈরি না। সম্ভবত একটু জলদি চলে এলো এই ফরম্যাটে।'

সাকিবের শুরুর সেই অধিনায়ক ভুল প্রমাণিত হয়েছেন।

২০০৮ সালে চট্টগ্রাম টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মুল স্পিনার হিসেবে তাকে খেলান তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্স। তার সেই সিদ্ধান্তটা ছিল মাস্টারস্ট্রোক। সেই টেস্টে ৭০ ওভার বল করে ১১৫ রানে ৯ উইকেট শিকার করে সাকিব জানিয়ে দেন, তার শুরুর সময়ে মোটেও কোন ভুলচুক কিছু হয়নি।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব যুগের সেই শুরু।

এটুকু শুনে মনে হতে পারে টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের ১ থেকে ৫৫, এই সময়ে পুরোটাই বোধকরি ফুলে ভরা পথ, ভুল!

এই পথচলায় সাকিব যেমন মজা করেছেন। ঠিক তেমনি মস্করারও শিকার হয়েছেন। আজ থেকে দশ বছর আগে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে একটু শীর্ষ সারির দলগুলোর যে কেউই সামনে পেলেই বিনামূল্যে প্রেসক্রিপশন দিতে শুরু করতো। দেখা গেছে তিনদিনেই হয়তো ম্যাচ শেষ। ড্রেসিংরুমে এসে ইনিংসে জয়ী দলের কোন ক্রিকেটার বাংলাদেশের বাকিদের সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

সেই সান্ত্বনায় যতখানি না আন্তরিকতা থাকতো, তারচেয়ে অনেক বেশি ঝরতো শ্লেষ, উপহাস।

শুনতে হয়েছে লাগাতার ঠাট্টা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে পঞ্চমদিনের টিকিট ছাপানোর প্রয়োজন কী? একদিনে দুবার বাংলাদেশকে অলআউট করে কী টেস্ট ম্যাচ একদিনেই শেষ করা যায় না? টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রতিযোগিতা নষ্ট করে দিচ্ছে বাংলাদেশ। অসম লড়াই। গালিভারের সঙ্গে ম্যাচ হচ্ছে লিলিপুটদের। বাংলাদেশকে টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিতীয় স্তরে খেলা উচিত।

এমনতর অনেক হাসি-মস্করা শুনতে হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটার, ক্রিকেট কর্তা এমনকি সাংবাদিকদেরও। তবে এসব মন্তব্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও যন্ত্রণায় পুড়েছেন মাঠের ক্রিকেটাররা। সেই যন্ত্রণা অনেকে সহ্য করতে পারেননি। তারা ছিটকে গেছেন। আর যারা কষ্টের সেই আগুনে পুড়ে ক্রিকেটকে জয় করার জেদ ধরেছিলেন সেই তারাই আজ হাসতে পারছেন গর্বের হাসি। অসামান্য সেই তালিকার একজন সাকিব আল হাসান।

আজকের এই স্বীকৃতি এবং পেছনের বন্ধুর এই পথচলার লড়াইয়ে কোন অবদানকেই এককভাবে শুধু নিজের নামের পাশে ঝুলিয়ে রাখতে চান না সাকিব। স্বীকৃতি অর্জনের এই লড়াই জেতার কৃতিত্বে সাকিব এমনকি মাঠের ঐ বলবয়ের পরিশ্রমকেও ‘ম্যান অব দ্যা ম্যাচের’ মর্যাদা দিচ্ছেন। আর বদলে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই পথচলার সঙ্গী হওয়াতেই সাকিবের আনন্দ।

ছোট্ট আরেকটা উদাহরণ

সাকিবপূর্ব টেস্ট যুগে বাংলাদেশ মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল। আর বাকি জয়ী ১২ টেস্টের সবগুলোই সাকিবীয় যুগে। ক্যালেন্ডারে সময়ের হিসেব যেমন খ্রিস্টপূর্ব এবং খ্রিষ্টাব্দ এই দুইভাগে বিভক্ত। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পর্যালোচনা পর্বকেও আপনি অনায়াসে ‘সাকিবপূর্ব’ এবং ‘সাকিবীয়’ এই দুইভাগে ভাগ করতে পারেন।

অর্জন। সাফল্য। স্বীকৃতি। মর্যাদা, এমনসব তুল্যমূল্যের লক্ষণ রেখাটা তাহলে নির্ভেজাল হবে।

তবে সাকিব খেলতে নামলেই যে বাংলাদেশ সব ম্যাচ জিতে যাবে। অথবা সাকিব একাই বাংলাদেশকে প্রতি ম্যাচে জিতিয়ে আনবেন। এমন অপরিমিতবোধ থেকে সমর্থকদেরও বেরিয়ে আসতে হবে। ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব যেমন পরিণত হয়েছেন। সমর্থকদেরও এখন সেই যুগে প্রবেশ করতে হবে। আর যাই হোক, এমন ক্রিকেটারের ওপর থেকে কখনোই আস্থা হারাতে নেই।

বাংলাদেশের জান, সাকিব আল হাসান, আদুরে স্লোগানটা তখনই তাহলে সার্থক হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর