বাংলাদেশের জয়ে ‘এক্স’ ফ্যাক্টর মাশরাফি

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 05:17:25

বাংলাদেশ ক্রিকেটে দুটি প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। সেরা অলরাউন্ডার ও সেরা অধিনায়ক কে? এই দুই প্রশ্নে ভোটাভুটি হলে নিশ্চিত থাকুক সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মতুর্জা যে ভোট পাবেন, রাজনীতিতে তাকে বলে ভূমিধস বিজয়!

তাদের এই জয় যে শুধুমাত্র আবেগের ছড়াছড়িতে তা কিন্তু নয়, ক্রিকেটীয় রেকর্ডই তাদের হয়ে কথা বলছে। তারা নিজেকে তৈরিই করেছেন অনেকের চেয়ে একটু ভিন্নতায়।

ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির মেয়াদটা সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ। অধিনায়ক হিসেবে শুরু করেছিলেন সেই ২০১০ সালে। মাঝে কিছুদিন ইনজুরির কারণে দলের বাইরে থাকায় সাকিব আল হাসান ও মুশফিক রহিম সেই দায়িত্বটা সামাল দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আগে ভাগ থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর থেকে এখনো মাশরাফি সেই সিংহাসনে। এই সময়কালে টি-টুয়েন্টি দলের অধিনায়কও মাশরাফিই ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের সময় হঠাৎ টি-টুয়েন্টি দল থেকে সরে দাড়ান। আর্ন্তজাতিক টি-টুয়েন্টিকে বিদায় জানান। ক্রিকেট বোর্ড অনেক সাধাসাধি করেও তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেনি। তবে এবার বিশ্বকাপে যাবার আগে স্পষ্ঠ করেই মাশরাফি জানিয়ে দিয়েছেন-‘এটাই আমার শেষ বিশ্বকাপ।’

খেলাটাও এখানেই ছেড়ে দিচ্ছেন কিনা সেটা এখনো চুড়ান্ত করেননি। খুব বেশি দুরের চিন্তা করার চেয়ে কাছের পরিকল্পনা সফল করতেই বেশি আনন্দ তার।

২০০১ সালের ৮ ডিসেম্বর ওয়ানডে দলে যখন মাশরাফির অভিষেক হয় তখন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ নিয়মিত হারতো। এমনকি জিম্বাবুয়েও তখন চোখ রাঙাতো! খেলোয়াড়ি জীবনে ক্যারিয়ারের প্রথম ১২ ওয়ানডেতে টানা হার দেখেছেন মাশরাফি। ১৩ নম্বর ম্যাচে এসে প্রথম জয়ের দেখা পান। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে সেটা ছিলো তার খেলা ম্যাচে প্রথম জয়। তারিখটা ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। প্রতিপক্ষ ভারত। ভেন্যু বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।

নিজের প্রথম জয়ের সেই ম্যাচে মাশরাফিই ব্যাটে-বলে সেরা পারফর্মার। ম্যাচ সেরা। অপরাজিত ৩১ রানের সঙ্গে ২ উইকেট। ভারতের বিপক্ষে ১৫ রানের জয়ে তার পারফর্মেন্সটাই সেরা। ১৩ নম্বর সংখ্যাকে সাধারণত অনেকেই ‘আনলাকি’ ভাবেন। কিন্তু নিজের সেই ১৩ নম্বর ম্যাচেই মাশরাফি বদলে দিলেন নিজের এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভাগ্যকে।

সেসময় যে বাংলাদেশ শুধু টানা ম্যাচ হারতো। সেই গর্ত থেকে দলকে বের করে আনলো মাশরাফির পারফরমেন্স। ভারতকে হারানোর সেই ম্যাচ দিয়েই বাংলাদেশ পেলো ক্রিকেটের নতুন ‘এক্স ফ্যাক্টর’! বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেটাই ভারতের বিপক্ষে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম জয়।

অবাক করা তথ্য হলো- ভারতকে হারানো বাংলাদেশের দ্বিতীয় জয়েও নায়ক সেই একইজন; মাশরাফি। তিনবছর পরে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মাশরাফিই ম্যাচ সেরা!

‘এক্স ফ্যাক্টরের’ আরো তালিকা খুঁজছেন? জানাচ্ছি।

বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ৭৭টি আর্ন্তজাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফি। জিতেছেনও বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৪টি ম্যাচ। জয়ের শতকরা রেকর্ড বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে তারই সর্বোচ্চ ৫৮.৬৬!

পেছনের চার বছরে দেশ ও দেশের বাইরে মিলিয়ে ৯টি ওয়ানডে সিরিজ জয়। অধিনায়ক হিসেবে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলকে ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবারের মতো হারানো। টানা দুই বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেয়া। পুরো দলকে বন্ধুর স্নেহে বাঁধেন, আবার অভিভাবকের মতো পাশে দাড়ান। দুই পায়ে সবমিলিয়ে ছয়টা অস্ত্রোপচার হয়েছে। তারপরও শুরুতে, নয়তো মাঝে অথবা ডেথ ওভারে-দলের যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে নিংড়ে দিতে চলে আসেন। এখনো যে কায়দায় ফিল্ডিং দেন, ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটির ইঞ্চিখানেক ওপর থেকে একহাতে ক্যাচ ধরেন, পুরোটা সময় জুড়ে যে এনার্জি খরচ করেন, সেই দুরুন্তপনায় পুরোদুস্তর গ্রামের কিশোরের চঞ্চল বিচরণ যেন!

নড়াইলের মেঠোপথ, বন-বাদাড়, তরতরিয়ে ডাব গাছে উঠে পড়ার সেইসব দিন, চিত্রা নদীর ঢেউয়ে কুল পেরুনো সাঁতার-নিজের সব সুন্দর স্মৃতি, সব সাহসকে সঙ্গে করে ক্রিকেট মাঠে নামেন বলেই তো মাশরাফি যেমন জিতছেন ২২ গজের লড়াই, ঠিক তেমনি মানুষের মনও!

অধিনায়ক মাশরাফির মানেই তার কথায়, উপস্থিতিতে এবং পারফরমেন্সে পুরো দলের চনমনে চাঙা হয়ে উঠা। ঝিমিয়ে পড়া দলকে কিভাবে তাতিয়ে তুলতে হয়, দলের প্রত্যেকের ভেতর থেকে সেরা খেলাটা বের করে আনার তাগিদ জাগিয়ে তুলতে হয়- সেটা অধিনায়ক মাশরাফির চেয়ে বেশি আর কারো জানা নেই সম্ভবত।

কটা উদাহরণ।

শেষ এশিয়া কাপের ফাইনালে লিটন দাস যখন হাফসেঞ্চুরি করলেন, ড্রেসিংরুমের দরজায় এসে দাড়িয়ে মাশরাফি ডানহাত বুকের সঙ্গে লাগিয়ে জানালেন-‘বুক চিতিয়ে খেলো!’ পরমুর্হূতে দুই হাত প্রশসারিত করে লিটনের দিকে ঈশারা করলেন-‘ইনিংস লম্বা করো’।

লিটন সেই ম্যাচে ইনিংসটা লম্বা করলেন, সেঞ্চুরি করলেন!

সবাই যখন সাব্বির রহমানের বিপক্ষে। তখনই তার কাঁধে অধিনায়কের হাত। অনেক সমালোচনা সত্তে¡ও তাকে দলে নিলেন অধিনায়ক। সেই সাব্বির নিউজিল্যান্ড সফরে ঠিকই ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি ফিরলেন! সাত নম্বরে একজন মারকুটো ব্যাটসম্যান খোঁজার সমস্যা কাটলো।

ক্রিকেট মাঠে টিম ম্যানেজমেন্ট বলে একটা কথা আছে। সেই ম্যানেজমেন্টে মাশরাফি ওস্তাদ ক্রিকেটার।

বাংলাদেশের সাফল্য মানেই তাতে মাশরাফির কিছু না কিছু ভুমিকা অবশ্য থাকবে। এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফি যেসব ম্যাচে তিন বা তারচেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন, এমন ৩৩টি ম্যাচের ২২টিই বাংলাদেশ জিতেছে।

-কি ‘এক্স ফ্যাক্টর’ পেলেন তো!

এ সম্পর্কিত আরও খবর