৮৩০ বছর আগের সরাইখানায় এক বিকেল

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম, নটিংহ্যামশায়ার, ইংল্যান্ড থেকে | 2023-08-31 21:18:57

এরা বলে পাব বা ইন্।

বাংলায় কি বলা যায়-সরাইখানা শব্দটাই সবচেয়ে বেশি যুতসই। তবে আসলে এটা নেহাৎ শুধু পানশালা নয়, সেই পরিচয় ছাপিয়ে আরো অনেক বড় কিছু! নটিংহ্যামের ঐতিহ্যের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই পাব। সাদা চুনকাম করা দেয়ালে কালো হরফে রোমান ক্যালিওগ্রাফিতে লেখা-দ্য ওল্ডেস্ট ইন্ ইন ইংল্যান্ড।

এই ওল্ড মানে কতো ওল্ড জানেন?

চলতি ২০১৯ থেকে ১১৮৯ খ্রীস্টাব্দ বিয়োগ করলে উত্তর মিললো-৮৩০ বছর! পেছনের পাহাড়ের গাঁ ঘেষে থাকা সরু-সাদা দোতলা বাড়ির অবকাঠামো, এর বৈশিষ্ঠ্য, ভেতরের আঙ্গিক, আলো-আধাঁরি পরিবেশ, বৈচিত্র -সবকিছুই এই পাবের বয়সের সত্যিকারের সার্টিফিটেকই দিচ্ছে। এগার’শ শতাব্দীর সেই পাথুরে গুহার অবয়বটা এখনো ধরে রাখা হয়েছে। ভেতরে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি আছে কিন্তু মাথার উপরে, পাশের দেয়ালের কঠিন প্রস্তর এবং প্রতিটি কাঠের গুঁড়ির পাশে ঝোলানো হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আজ থেকে ৮৩০ বছর আগের ইতিহাসে!



নটিংহ্যামের রবিনহুড ক্যাসেল থেকে ১০০ গজ দুুরের এই পাবকে দেখিয়ে শহরের লোকজন গর্বের সুরে ঘোষণা দেয়-এটা ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরানো সরাইখানা।

পাঁচ তারকা হোটেল পার্ক প্লাজা থেকে পায়ে হাঁটা দুরুত্ব নটিংহ্যাম ক্যাসেল। এখানে আসতেই তীরধনুকের মুর্তিতে বরিনহুডকে পাবেন। বরিনহুডের ব্রোঞ্জের মুর্তির পাশে দাড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পর্যটকদের হুড়োহুড়ি। এই যুগে এসেও তার এত ভক্ত-সমর্থক আছে জেনে রবিননহুড নিশ্চিতভাবে খুশি হবেন!


পাবের প্রবেশমুখের দরজার ফলকে বড় করে লেখা-ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরানো সরাইখানা। স্থাপিত ১১৮৯ খ্রীস্টাব্দ! বাইরের পুরো অংশটুকু গাছের সবুজ ছায়ায় ঢাকা। কাঠের চেয়ার-টেবিল পাতা। চারধারেই খানা পিনার আয়োজন। তবে শুধু পান আসক্তরাই যে এই আটশ বছর পুরানো পাবে এসে বিয়ারে গলা ভেজাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। নাস্তা এমনকি চাইলে দুপুরের ফুল কোর্স লাঞ্চও মিলবে এই পাবে। বালু ও পাথরের সংমিশ্রনে তেরি পাবের চাতালগুলো দেখলে একবার বসে চারধারের প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে খানিকক্ষনের জন্য হলো সঁপে দিতে ইচ্ছে হবে।



সরু প্রবেশ পথ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে মনে হলো-এ কোথায় এলাম? এ যে পুরো পাহাড়ের গর্ত। বিশালাকৃতি পাহাড়ের মাঝখানের অংশ কেটে টুপির মতো করে যেন ওপর থেকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে! ভেতরের আলোর মাত্রা এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে এগারো শতাব্দীর সেই আবহ’র সঙ্গে অতিথিরা পরিচিত হতে পারেন। আট’শ বছর পুরানো সেই পাথুরে চাঁইয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অদ্ভুত এক অনুভুতিতে পুরো শরীর মন আছন্ন হয়ে পড়বে। টাইম মেশিনে পেছনে ফিরে যাবার আয়োজন যেন করে রেখেছে নটিংহ্যামের এই সরাইখানা। ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট খুপরি। সবগুলোতে ঢুঁ মারতে গিয়ে আশপাশের অনেকের ঢুঁস খেতে হলো-কাঁধের ধাক্কায় পাশের জনের বিয়ারের গ্লাস থেকে খানিকটা ‘জল’ ছলকেও পড়লে-‘সরি, সরি!’ শেষ না হতেই সান্তনা মিলল-‘ওকে ম্যান, নো প্রবলেম। কিপ গোয়িং।’



স্টিলের রেলিং দেয়া দোতলায় উঠতে দেখা মিলল আরও জমজমাট আড্ডার। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বিকাল ও সান্ধ্যকালিন সময়টা উপভোগ করতে সবাই যেন সেই এগার শতাব্দী ফিরে গেছে! ইলেক্ট্রিক লাইনের পাশে গাছের শিকড় বের হয়ে পাথুরে পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে মিশে গেছে-কিন্তু কোনকিছুই এখানে বৈশাদৃশ্য মনে হবে না। বারটেন্ডার টমি অবশ্য শতাব্দী পুরানো এই সরাইখানায় কলসের ঢাকনা খুলে কোন কিছু ঢালছে না, বিয়ার এবং অন্যান্য পানীয় ঢালার জন্য আধুনিক বারের প্রায় সব আয়োজনই আছে এখানে। এত লোক, সবার হাতেই গ্লাস, সবাই একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে, চারধারে তুমুল আড্ডা, দারুণ উচ্ছাস, হৈচৈ-কিন্তু এই আড্ডার মাঝেও সরাইখানার বরফঠান্ডা পাথরের দেয়ালে হাত ছোঁয়াতেই যেন নিজেকে আবিস্কার করা গেল এগার’শ শতাব্দীর সেই যুগে।

সূর্য অস্ত গেছে। ফিরে আসার সময় সরাইখানার গেট পার হতে সামনের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির ছোটাছুটি। কিন্তু কানে যে তখনো বাজছে ঘোড়ার খুরের শব্দ!

এই মাত্র যেন হারানো পৃথিবী থেকে ঘুরে এলাম!

এ সম্পর্কিত আরও খবর