গোল্ডেন গার্ল সুলতানা কামাল খুকী

বিবিধ, খেলা

ড. মোঃ আসাদুজ্জামান মিয়া | 2023-10-06 12:15:21

বেঁচে থাকলে ৬৭-তে পা রাখতেন তিনি। ক্রীড়াঙ্গনের অদ্বিতীয়া এক নারী অ্যাথলিট- সুলতানা আহমেদ খুকী! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের স্ত্রী। ক্ষণজন্মা এই নারী ছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে যখন এ দেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনোই কঠিন ছিল সে সময়টাতে তার অ্যাথলেটিকসে যাত্রা।

১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকার বকশীবাজার মুসলিম গার্লস স্কুলে পড়াকালীন আন্তঃবিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে শুরু এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অ্যাথলেটিক ট্র্যাক দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। অ্যাথলিট হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ। হার্ডলস, হাইজাম্প এবং ব্রডজাম্প ছিল তার প্রিয় ইভেন্ট। এই তিন ইভেন্টে বরাবরই তিনি দেশে ও বিদেশের মাটিতে অসামান্য পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন।

জন্ম ১৯৫২ সালের ১০ ডিসেম্বর। বেড়ে উঠা পুরান ঢাকার বকশিবাজারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে। বাবা দবির উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী। মা জেবুন্নেছা বেগম গৃহিণী। নয় ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন অষ্টম এবং বোনদের মধ্যে সবার ছোট। মধ্যবিত্ত পরিবারে ছিলেন সবার খুব আদরের। মাত্র ২৪ বছর বয়সী সুলতানা কামালের ক্যারিয়ার ছিল বর্ণাঢ্যময়। পড়তেন পুরান ঢাকার মুসলিম গার্লস স্কুলে। তারপর গভ: ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বেগম বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজ)। ১৯৬৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। অনার্স শেষে একই বিভাগে ভর্তি হন মাস্টার্সে। ১৯৭৫ সালে মাস্টার্সের লিখিত পরীক্ষাও দেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান তিনি।



কথাবার্তা, আচার-আচরণ, পারফরম্যান্স সবকিছুতেই ছিলেন অনন্য অসাধারণ। ছিলেন বেশ চটপটে, ছটফটে, হাসিখুশি! দুষ্টুমিতে ছিলেন সেরা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও খেলার মাঠে তার মানবিক গুণাবলি সবাইকে মুগ্ধ করত। ছোটদের যেমন স্নেহ করতেন আবার বড়দের প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ছিলেন সবার প্রিয় মানুষ, প্রিয় মুখ। মুখে সবসময় হাসি থাকত আর হাসি দিয়েই সবার মন জয় করে নিতেন। ছিল না কোনো অহংকার। এমনকি বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হওয়ার পরও ছিলেন সাধারণের মতোই।

বিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে চেনা জানা থাকলেও বিয়ে হয় পারিবারিক ভাবে। দুই পরিবারের সম্মতিতেই। দুই পরিবারের মধ্যে সখ্য ছিল আগে থেকেই। বিয়ের পর সুলতানা আহমেদ হন সুলতানা কামাল। থাকতেন ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ির তিন তলায়। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও ঘাতকদের নির্মমতার শিকার হন। বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় মেহেদির রঙ মুছে যাওয়ার আগেই নিহত হন তিনি। ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ির দোতলার শোবার রুমে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে (বুক ও পেটে) রক্তাক্ত অবস্থায় সুলতানা কামালের নিথর দেহটি পড়েছিল অন্য সবার মাঝে। তখনও তার দু’হাতে শোভা পাচ্ছিল সদ্য বিয়ের মেহেদির আলপনা। রক্তের রঙ আর মেহেদির রঙের মাখামাখি হয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন।

ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন খেলাধুলায় ছিলেন দারুন পারদর্শী। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুধু মেধাবী ছাত্রীই ছিলেন না, ছিলেন সবার সেরা অ্যাথলিট। আন্তঃস্কুল ও কলেজ প্রতিযোগিতায় বরাবর শীর্ষস্থান ধরে রাখতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তৎকালীন পাকিস্তান অলিম্পিকে নতুন রেকর্ড স্থাপন করে স্বর্ণপদক জয়লাভ করেছিলেন (১৯৬৭-৬৮)। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মূলত তার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় দল জাতীয় পর্যায়ের লড়াইয়ে একাধিক পদক জয় করেছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ব্লু ছিলেন (১৯৬৯-৭০)। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১৯৭৩, ’৭৪ এবং ’৭৫ সালে পর পর  অংশ নেন এবং রের্কড গড়েন।



‘অলইন্ডিয়া রুরাল গেমসে’ লাভ করেন রৌপ্যপদক (১৯৭৩)। ক্রীড়া জগতে অসামান্য অবদানের জন্য ডাকসু তাঁকে বিশেষ পদকে সম্মানিত করে (১৯৭৩)। ১৯৭৩ সালে জাতীয় ক্রীড়ালেখক সমিতি কর্তৃক তিনি সেরা অ্যাথলিটও নির্বাচিত হন। তাছাড়াও নিজ কলেজের শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিট পুরস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অ্যাথলিটের পুরস্কার, ব্যাডমিন্টন পুরস্কারসহ আরো অনেক সাফল্য ছিল তার ঝুলিতে। ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পরে তাকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক ও ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়। এসব পুরস্কার থরে থরে সাজানো ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বাড়ির একটি কক্ষে। আফসোস, ঘাতকরা তাকে মারার পাশাপাশি তার অর্জনগুলোকেও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।

ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তার নামে ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স’, বকশিবাজারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোয়ার্টারে থাকতেন, সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে ‘সুলতানা কামাল স্মৃতি কমপ্লেক্স’, তার স্মরণে ঢাকার ডেমরা-তারাবোতে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ‘সুলতানা কামাল সেতু’।



তার মূল বাড়ি ঢাকার মাতুয়াইলে পরিবার ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে চলছে ‘সুলতানা কামাল স্মৃতি পাঠাগার’ কার্যক্রম। এই কৃতি অ্যাথলিটের সুনাম ও দ্যুতি সারা দেশে বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রীড়ামোদী নতুন মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া দরকার। যা এই প্রজন্মের মেয়েদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ যোগাতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে সুলতানা কামালের অবদান অনেক। দেশের জন্য তিনি অনেক সুনাম বয়ে এনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী খেলাধুলায় নিজেকে উৎসর্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লড়াই, সাহস আর সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ছিল তাঁর চরিত্রে। তাঁর হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তিময় মুখাবয়ব এখনও এ দেশের নারী খেলোয়াড়দের জন্যে অন্যরকম এক অনুপ্রেরণার উৎস। তখনকার প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন রোল মডেল । আমাদের দুর্ভাগ্য, তার মতো গুণী অ্যাথলিটকে আমরা অকালেই হারিয়েছি। পঁচাত্তরের পনের আগস্টে ঘাতকদের হাতে ক্রীড়াক্ষেত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনপ্রদীপ চিরতরে নিভে যায়। তাই শোকের এই মাসে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সকল শহীদসহ শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি এই কৃতি অ্যাথলিটকে, যিনি মন, মননে, চলায়, বলায়, দর্শনে, অর্জনে সত্যিই ছিলেন একজন গোল্ডেন গার্ল। স্যালুট প্রিয় অ্যাথলিট সুলতানা কামাল খুকি।

লেখক: ভিজিটিং সায়েনটিস্ট, এনাসটাসিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, সেন্ট অগাস্টিন, ফ্লোরিডা, আমেরিকা ও সহযোগী অধ্যাপক (ডেপুটেশন), কীটতত্ত্ব বিভাগ, পবিপ্রবি, বাংলাদেশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর