মুস্তাফিজ হঠাৎ কেন ‘ফিউজ’?

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-25 21:14:28

কোমল পানীয়’র বোতলের ছিপি বন্ধ করে খুব ঝাঁকাচ্ছেন। খানিকবাদে সেই ঝাঁকুনি শেষে ছিপি খুললেন।

যা পেলেন তা এমন।

হিসহিস করে অনেকক্ষণ ধরে শব্দ হলো। বড় বুঁদবুঁদ উঠল। ভেতর থেকে উড়ে আসা বাতাসে সামনের অংশ উড়ে গেল! এতক্ষণ যে বর্ণনা শুনলেন তাকে একশব্দে বলে- ফিজ!

মুস্তাফিজের বোলিংয়ের সামনে ব্যাটসম্যানদের এমনই উড়ে যাওয়া বা উইকেট উপড়ে পড়ার একটা সাদৃশ্য থাকায় ভক্ত-সমর্থকরা আদর করে মুস্তাফিজকে ডাকতো- দ্যা ফিজ!

২০১৬ সালের আইপিএলে দুর্দান্ত সাফল্যের প্রেক্ষিতে মুস্তাফিজুর রহমানের নামের পাশে এই পদবীটা বসে যায়। কাটার, ফুললেন্থ, কোনাকুনি বোলিংয়ের দক্ষতা, স্লোয়ার ডেলিভারি, স্পিনের ভঙ্গিতে শেষ মুহূর্তে গ্রিপ বদলে ফেলা, স্লোয়ার বাউন্সার, ফাস্টার ইয়র্কার- পেস বোলিংয়ের এসব বৈচিত্র্যময় গুণাবলী তাকে বিশ্ব ক্রিকেটে বিস্ময়কর বোলারের মর্যাদা দিয়েছিল।

সেই গল্প এখন পুরনো। ফিজ যে এখন প্রায় ‘ফিউজ’ হওয়ার পথে!

সর্বশেষ সাতটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং পারফরম্যান্স পরিষ্কার জানান দিচ্ছে-সামথিং ইজ রং। চলতি বছর সবমিলিয়ে ৭টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা মুস্তাফিজের উইকেট শিকারের সংখ্যা মাত্র ৪টি। আর ভারতের বিপক্ষে শেষ হওয়া তিন ম্যাচের সিরিজে কোনো উইকেটই পাননি। তিন ম্যাচেই কখনোই বল হাতে প্রভাবী ভূমিকা রাখা তো দূরের কথা, বরং সঙ্কট আরো বাড়িয়েছেন। অথচ এই সিরিজে তিনিই ছিলেন দলের সেরা বোলিং বিভাগে সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং সিনিয়রদের একজন। সিরিজের প্রথম ম্যাচে ২ ওভারে ১৫ রান দেওয়ার পর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ তাকে আর বোলিংয়েই ডাকেননি। দ্বিতীয় ম্যাচে ৩৫ রান খরচ। নাগপুরে দলের সবচেয়ে খরুচে বোলার তিনিই। ৪ ওভারে কোনো সাফল্য ছাড়াই ব্যয় ৪২ রান।

তিন ম্যাচে ৯.৪ ওভারে ৯২ রান খরচায় উইকেট শূন্য! অথচ সিরিজ শুরুর আগে দলের সবচেয়ে প্রভাবী বোলারের তকমা লেগেছিল তার নামের পাশে।

চলতি বছর এটাই ছিল তার শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। আর সেটাই হলো সবচেয়ে বাজে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন ক্রিকেটারের মন্দ সময় যেতেই পারে। সম্ভবত টি-টোয়েন্টিতে মুস্তাফিজেরও সেই গ্রহণকাল চলছে। কিন্তু তাই বলে একজন ম্যাচ উইনার বোলার হঠাৎ করে তার বোলিংয়ের বেসিক কেন ভুলে যাবেন?

নাগপুরের শেষ ম্যাচের প্রসঙ্গেই ফিরি। এই ম্যাচে তার ৪ ওভারের বোলিংয়ের শতকরা ৭৫ ভাগ বল শর্ট পিচে ফেলেছেন মুস্তাফিজ। অথচ স্লো এবং গ্রিপিং এই উইকেট ছিল তার বোলিংয়ের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র। ফুললেন্থে বল ফেলার মতো সাহস না দেখালে কাটার কোনো কাজে লাগবে না।

কাটার তখন নেহাৎ বাটার!

এই ম্যাচে মুস্তাফিজের বলকে সেই মাখনই বানিয়ে টোস্ট করেছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। উপরের দিকে যে ক’টি বল রাখতে পেরেছেন মুস্তাফিজ সেটাই তার কাজে লেগেছে। সেই বলগুলো থেকেই তেমন রান আসেনি। শর্ট অব লেন্থে পড়া বলগুলো থেকেই রান খরচ হয়েছে।

এই যুগের ক্রিকেটে কোনো বোলার বা ব্যাটসম্যানের রহস্য ভেদ করা এখন আর কঠিন কিছু নয়। ভিডিও ক্লিপস বিশ্লেষণের মাধ্যমে একে অন্যের শক্তি-দুর্বলতা খুঁজে বের করার সুযোগ করে দিয়েছে এই সময়ের ক্রিকেট প্রযুক্তি।

তবে তারপরও কথা থাকে। যতই আপনি প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে মাঠে নামুন না কেন, ২২ গজের ঐ লড়াইয়ে কৌশল, দক্ষতা, উৎকর্ষতার সঙ্গে মানসিক দৃঢ়তাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সেই দৃঢ়তার বড় বেশি ঘাটতি দেখা যাচ্ছে মুস্তাফিজের বোলিংয়ে। এক সময়ের চ্যাম্পিয়ন বোলারকে হঠাৎই এখন অনেক বেশি মামুলি দেখাচ্ছে। অসাধারণ হয়ে উঠা একজন আকস্মিকভাবে যেন এখন অতিশয় সাধারণ!

আপনি আগে কোনোসময় কোনোকালে কি করেছেন সেটা দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মূল্যায়নের সুযোগ নেই। এখানে প্রতিযোগিতা এমনই তীব্র যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শেষ ম্যাচটায় আপনি কেমন করেছেন- সেই পারফরম্যান্স দিয়েই তুল্য-মূল্যে বিবেচ্য। টি-টোয়েন্টিতে মুস্তাফিজের এখন সেই গ্রহণকাল চলছে!

তবে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সিরিজে পুরোদুস্তর ব্যর্থ মুস্তাফিজের পাশে ঠিকই ছায়া হয়ে থাকলেন। অধিনায়ক বলছেন-‘মুস্তাফিজ চ্যাম্পিয়ন বোলার। প্রত্যেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারেই এমন সব বাজে সময় যায়। আমি মনে করি তার এই বাজে সময়ে আমাদের সবার তাকে সমর্থন করা উচিত। তাকে একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার মতো কোনো চিন্তাই মাথায় আনা উচিত না। কোনো সন্দেহ নেই ভালো পারফরম্যান্স করার জন্য সে অনেক কষ্ট ও চেষ্টা করছে। একটা ম্যাচে ভালো করতে পারলেই দেখবেন আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পাবে মুস্তাফিজ।’

ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের এই সিরিজে বাংলাদেশ অনেক দিন মনে রাখলেও মুস্তাফিজ কিন্তু দ্রুতই ভুলে যেতে চাইবেন। এই সিরিজ তার জন্য এরকম-‘ঐ যে, আমি যে সিরিজে উইকেট শূন্য ছিলাম!’

এ সম্পর্কিত আরও খবর