রিপোর্টারের ডায়েরিতে নাগপুর দর্শন

ক্রিকেট, খেলা

আপন তারিক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-22 12:18:45

নাগপুর (ভারত) থেকে: নাগপুরে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচ থেকে সুখ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। এখানে ৩০ রানে জয়ী ভারতের হাতেই উঠেছে সিরিজের ট্রফি। এই ম্যাচ কাভার করতে আসা বার্তাটোয়েন্টিফোরের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আপন তারিক শুধু ক্রিকেটেই মজে ছিলেন না। নাগপুরের নাগরিক জীবনেও ঢু মেরেছেন। নাগপুর নিয়ে এই ট্যুর ডায়েরিতে সেই জীবনের গল্পই জানাচ্ছেন তিনি।

ভারতের নাগপুরের স্বামীনারায়ণ মন্দির

এখন বিয়ের মৌসুম

বেশ কঠিন শব্দ-এক্রোফোবিয়া! বিকল্প শব্দটাও আরও খটমটে- এলটোফোবিয়া। যারা এই সাইক্রিয়াট্রিক ভাষা বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য সহজ অর্থ দাঁড়ায়-উচ্চতা ভীতি। সমস্যা নিজের বলেই উইকি ঘেঁটে অনেকদিন আগেই জেনে নিয়েছিলাম শব্দটা। আর এই ভীতি থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে আকাশ পথে একটা কৌশল বেশ কাজে দিচ্ছে। পাশে বসা অপরিচিত কারো সঙ্গে টুকটাক কথা বলা!

কলকাতা থেকে নাগপুর যেতে সেটাই কাজে লাগিয়েছিলাম। ৮ নভেম্বর, আহমেদাবাদ থেকে সিটি অব জয়ে পা রেখে শহরটা অবশ্য দেখা হলো না। কানেক্টিং ফ্লাইটে উড়ে যেতে হবে নাগপুর। মহারাষ্ট্র রাজ্যের এই শহরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি। সন্ধ্যায় আমরা যখন উড়ানে উঠবো তখনই শুরু হয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাব!

বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিচ্ছিল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দর রানওয়ে! ফ্লাইট উড়বে কী উড়বে না এই ছিল দুশ্চিন্তা। ভয় ধরে যাচ্ছিল মনে। শেষ পর্যন্ত দেড়ঘণ্টা দেরিতে উড়ল ইনডিগো এয়ারলাইন্সের বিমান। বৈরি পরিবেশের কারণে ভয়টাও বেশ ঝাঁকিয়ে ধরছিল। ব্যস, পাশের সিটের কারো সঙ্গে কথা বলার কৌশলটা নিতেই পরিচিত হলাম ২৪ বছর বয়সী বিবেক প্রসাদের সঙ্গে।

বন্ধুর বিয়েতে আমন্ত্রিত, মুম্বাই থেকে কলকাতা হয়ে যাচ্ছে নাগপুরে! ওর কাছেই শুনলাম এখন নাকি বিয়ের মৌসুম চলছে মহারাষ্ট্রের রাজধানীতে। গ্রাম-থেকে শহরজুড়ে সর্বত্রই বাজছে বিয়ের বাদ্য।

নাগপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান দীক্ষাভূমি

হঠাৎ কেন সাতপাকে বাঁধা পড়ার হিড়িক পড়ল?

প্রশ্নটা রেখেছিলাম সহযাত্রী বিবেক প্রসাদের কাছে, যিনি ব্যবসার কাজে এসেছেন নাগপুরে। উঠেছেন শহরের তিন তারকা হোটেল ইয়াত্রি-তে। তিনিই জানালেন, ৯ নভেম্বর, শনিবার থেকে শুরু হয়েছে তাদের উৎসব। তিনি বলছিলেন  'একটা মিথ চালু আছে এখানে, সত্য মিথ্যা জানি না। এখানকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তা মেনে চলেন। তাদের বিশ্বাস ভগবান বিষ্ণু বছরে চার মাস ঘুমিয়ে থাকেন। এই সময়টাতে কেউ কোন উৎসব কিংবা বিয়ে পারতপক্ষে করে না এখানকার মানুষ। বাকি ৮ মাস চলে নানা আনুষ্ঠানিকতা। ৮ নভেম্বর তুলসি পূজার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে তাদের উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। মানে ঘুম ভেঙেছে ভগবান বিষ্ণুর।

অন্তর্মুখী তবে...

নাগপুরের মানুষ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালবাসে। শান্তিপ্রিয় এই শহরের মানুষরা রাজনীতি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায় না। তিনদিন এই শহরে থেকে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। তাদের দাবি এখানে সব মতের মানুষরাই সমান অধিকার নিয়ে টিকে আছে। এমন কী রাজনীতি নিয়ে তেমন সরবও নয়।

নানা ধর্মের মানুষের বসবাস থাকলেও কখনো সেভাবে বিদ্বেষ ছড়ায়নি বলেই দাবী গৌতম বসুর। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের এই তরুণ এখন নাগপুরেই আবাস গড়েছেন। সেখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। তিনিই জানালেন, 'দেখুন, আমি নিজে বাঙালি। অথচ ওদের এখানে অনেক দিন ধরে ব্যবসা করছি কোন সমস্যাই হচ্ছে না! সবাই মিলে মিশে আছি শহরে।'

অনেকটা অন্তর্মুখী এই শহরের মানুষরা। নিজের মধ্যেই থাকতে ভালবাসেন তারা। তবে কথা বলতে শুরু করলে তখন আপন করে নিতে সময় নেয় না। তবে আমরা যখন শহরে পা রাখি তখন অযোধ্যার রাম মন্দির আর বাবরি মসজিদ নিয়ে আদালতের রায় নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা ছিল। এ কারণে ভিনদেশিদের হোটেল পেতেও বড় সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

২৪ লাখের কিছু বেশি মানুষের বসবাস নাগপুরে। অনেকেই আবার এটি বলে থাকেন ভারতের শিক্ষা কেন্দ্র! দুর্দান্ত সব মেধাবীর জন্ম মহারাষ্ট্রের এই এলাকায়। পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী। স্বাক্ষরতার হার ৭৯%।।পুরুষদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ৮৩% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭৫%!

নারীদের সমান তালে এগিয়ে চলাটাও বেশ চোখে পড়েছে। বিশেষত রাস্তায় স্কুটিতে মেয়েদের সংখ্যাটাই বেশি। তাদের সামাজিক নিরাপত্তাটা যে মজবুত সেটা টের পাওয়া যায়। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তো আর এমন বলয় তৈরি করে দিতে পারে না!

নাগপুরকে বলা হয় অরেঞ্জ সিটি, তবে বাজারে এখনও কমলা তেমন ওঠেনি

কমলার শহর

নাগপুরকে বলা হয় অরেঞ্জ সিটি, মানে কমলার শহর। কিন্তু আমরা যে সময়টাতে এসেছি তখন কমলা মাত্র বড় হয়ে উঠছে। এখন সুস্বাদু হয়নি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই বাজারে আসতে শুরু করবে নাগপুরের কমলা। দামটাও নাকি তখন একেবারে হাতের নাগালে থাকে। বিস্ময়কর হলেও সত্য তখন ১০০ কমলা বিক্রি হয় ৮০ রূপিতে! চার থেকে পাঁচ টাকা পাওয়া যায় এক কেজি কমলা! পানির চেয়েও সস্তা!

আর সেই কমলা গুলি বেশ রসালো আর মিষ্টি কোয়াযুক্ত। নাগপুর কমলার ভৌগলিক সূচক (জিআই) পেয়েছে অবশ্য বেশ পরে ২০১৪ সালে। তার আগেই এই শহরটি কমলার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে।

মৌসুম না থাকলেও নাগপুরের রাস্তার আশপাশে দোকানে সাজানো আছে কমলাসহ নানা জাতের ফল। আর দামটাও তেমন আহামরি নয়। ভারতে কমলার সবচেয়ে বড় যোগানদাতা এখন নাগপুর।

তারি পোহা ও ভেজ বিরিয়ানি

তিনদিনেই বুঝে গেছি রাজকোটের মতো এখানেও বেশিরভাগ মানুষই ভেজিটারিয়ান। তবে গুজরাটের শহরের মতো মহারাষ্ট্রের এই তৃতীয় বৃহত্তম শহরে ননভেজ রেস্টুরেন্টও আছে। সেখানে অবশ্য তেমন ভিড় নেই বললেই চলে। রাতের খাবার খেতে গিয়ে দেখেছি ভেজ রেস্টুরেন্টে ভিড়ের কারণে বসাই যায় না। আর ননভেজ রেস্টুরেন্টে আমাদের মতো কিছু মানুষের আনাগোনা!

এখানকার মানুষরা বেশ ভোজন রসিক। একেবারে সবচেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষরাও নাকি সপ্তাহে অন্তত দু'দিন বাইরে খাবেন। বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে দুপুর আর রাতের মেন্যুতে দেখেছি ভেজিটেবলেই বেশি টান।

সকালের খাবারে অধিকাংশ মানুষের পছন্দ 'তারি পোহা' নামের এই খাবার

সকালের খাবারে অধিকাংশ মানুষের পছন্দ 'তারি পোহা' নামের এক খাবার। আমরা নিজেরাও খেয়ে দেখেছি। দশ রূপি প্রতি প্লেট। মনে হচ্ছিল চিড়া দিয়ে খিঁচুড়ি বানানো হয়েছে। খেতে অবশ্য মন্দ লাগে না। স্থানীয় ছত্রপতি বাস স্টপেজে এই তারি পোহা খেতে লম্বা লাইন পড়ে যায় প্রতিদিন সকালে।

আবার মমিনপুরা বিরিয়ানির নামটাও শহরে পা দিয়েই শুনেছি। যেখানে ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যেই মেলে বাসমতি চালের বিরিয়ানি।

নাগপুরের মানুষদের পছন্দে খাবারের তালিকায় আছে এই বিরিয়ানি। তবে সেই বিরিয়ানি মাটন কিংবা চিকেনের নয়। ভেজিটেবল দিয়ে তৈরি সেই খাবার অবশ্য আমাদের জন্য তেমন লোভনীয় ছিল না। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে খাবারটি বেশ প্রিয়। রাস্তার পাশের দোকানে চাট, সাউজি, সমোসা আর জিলাপির দোকানেও বেশ ভিড়!

নাগপুরের বাসমতি চালের বিরিয়ানি

দেখার নেই কিছুই

নাগপুর পর্যটকদের শহর নয়-এমনটাই জানালেন নাগপুরে যে হোটেলে উঠেছি তার ম্যানেজার মুজিবুর রহমান। জানাচ্ছিলেন, এই শহরটা ঠিক ভারতের মাঝখানটায়। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যই এখানে সবাই আসে। নাগপুরে বেড়াতে কেউ আসে বলে জানা নেই আমার।'

যদিও শুধু ব্যবসার জন্য নয় চিকিৎসার জন্যও অনেকে আসেন নাগপুরে। একইসঙ্গে দেখার যে কিছু নেই তাও কিন্তু নয়। যে মাঠে বাংলাদেশ দল রোববার সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি খেলেছে, সেই বিদর্ভ স্টেডিয়াম মুগ্ধ করবে যে কাউকে। ভারতের আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মধ্যে আয়তনে এটিই সবচেয়ে বড়।

যারা বন্য প্রাণী ভালবাসেন তাদের জন্য এই নাগপুরেই আছে একাধিক অভয়ারণ্য। যেখানে অন্য অনেক প্রাণীর সঙ্গে দেখা মিলবে বাঘেরও। সঙ্গে জাদুঘর, চিড়িয়াখানারও কমতি নেই! তবে ব্যবসায়িক চিন্তা যাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তারা একবার ঢু মারতে পারেন নাগপুরে। কারণ অল্প পুঁজিতে বড় কিছু করার নজির নাগপুরের অধিবাসীরাই নাকি প্রথম দেখিয়েছে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর