স্বর্গোদ্যানে এক ঝলক!

ক্রিকেট, খেলা

আপন তারিক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ইন্দোর (ভারত) থেকে | 2023-08-31 21:24:12

গেট দিয়ে ঢুকতেই এক ভারতীয় সাংবাদিক বললেন, ভিতরে স্বর্গ প্রতীক্ষায় আছে!

-কথাটার মানে মিনিটের মধ্যেই বুঝে যাব কে জানতো? বাস থেকে নেমেই দেখি ফুল হাতে দাঁড়িয়ে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা। যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ঠায় দাঁড়িয়ে! তারপরের প্রতিটি মিনিট, সেকেন্ডই সঙ্গী হয়েছে স্বর্গ সুখের অনন্য অভিজ্ঞতা।

ইন্দোর শহর ছাড়িয়ে আমরা গিয়েছিলাম এবি রোডে আকাশবাণী অফিসের ঠিক বিপরীত পাশের এক স্বর্গোদ্যানে। হ্যাঁ এটা তো স্বর্গই! দ্য এমেরাল্ড হাইটস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল! উপলক্ষ্যটা ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের সাংবাদিকদের মধ্যে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ। মধ্য প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এমন চমক রাখবে আঁচ করতে পারিনি।

অনিন্দ্য সুন্দর দ্য এমেরাল্ড হাইটস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ভবন

আসলে পুরো ইন্দোরই ছবির মতো সাজানো। আর ইংলিশ মিডিয়াম এই স্কুলটি স্বপ্নের মতো এক জায়গা। স্কুলের প্রধান ভবন পেরোতেই চোখে পড়ল শুধুই রঙের মিছিল। কেজি থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা চলে এই স্কুলে। ভারতের দ্বিতীয় সেরা বোর্ডিং স্কুল। একশ একরের ওপর বিশাল ক্যাম্পাস! স্কুলের দালানগুলো দেখে মন জুড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ঘোরে মনে হলো যেন হ্যারি পটারের জাদুর স্কুল হগওয়ার্টসে পা রেখেছি আমরা।

সেই স্কুলেরই ফুটবল মাঠে সোমবার মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ-ভারত ইন্দোর টেস্ট কাভার করা সাংবাদিকরা। অতিথি দলের নেতৃত্বে থাকলেন ইএসপিএন-ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম। অবশ্য ম্যাচটা নিছকই প্রীতির লড়াই, যেখানে বন্ধুত্বার বার্তাটাই ছিল সবার আগে!

টেপ টেনিস বলে যখন ক্রিকেটে মেতেছেন সাংবাদিকরা, আমার চোখ তখন অনিন্দ সুন্দর এই ক্যাম্পাসে। কথা হচ্ছিল স্কুল ছুটি শেষে বোর্ডিংয়ে ফেরা শিশুদের সঙ্গে। যেন চোখ-মুখ ঠিকরে বেরোচ্ছে ওদের বুদ্ধিমত্তা। ওদেরই একজন ক্লাস সেভেনে পড়া চেতন রাঠৌর।

যোদপুরের এই কিশোর বলছিল- 'বিশাল ক্যাম্পাস আমাদের। একশ একরের বেশি জায়গা নিয়ে এই স্কুল। এখানে তিনটি ফুটবল মাঠ, বড় একটি ক্রিকেট গ্রাউন্ড রয়েছে। যেখানে খেলে গেছেন চেতেশ্বর পূজারার মতো ক্রিকেটার। আছে শ্যুটিং রেঞ্জ, সুইমিংপুল, জিমন্যাসিয়াম।'

সঙ্গে আছে ২৫টি টেবিল বসানো টেবিল টেনিস হল, ৬টি ডেকো টার্ফ টেনিস কোর্ট, ৯টি ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ৬টি স্কোয়াশ কোর্ট, বিলিয়ার্ড রুম, রানিং ট্র্যাক, সাইক্লিং ট্র্যাক ও ৪টি ভলিবল কোর্ট!

ছেলে-মেয়েদের সহশিক্ষা পরিচালনা করছে স্কুলটি সেই ১৯৮২ সাল থেকে। সময়ের হাত ধরে এটি মধ্য প্রদেশের সেরা তো হয়েছেই রেটিংয়ে ভারতের দ্বিতীয় সেরা বোর্ডিং স্কুল। চেতন রাঠৌর জানাচ্ছিল, 'আমরা বেশির ভাগ স্টুডেন্টই বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করছি। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আছে আলাদা হোস্টেল। আমরা শুধু এখানে দিন-রাত পড়াশোনাই করি না! নানা ধরনের খেলাতেও ব্যস্ত থাকি।'

এমেরাল্ড হাইটস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাঁতারুরা- ছবি: বিসিবি

অবশ্য মোবাইল ফোন একেবারেই নিষিদ্ধ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। তারপরও বাইরের বিশ্বের খোঁজ-খবর বেশ ভালোই জানা আছে তাদের। এমন কী বাংলাদেশ ক্রিকেটের টুকটাক খবরও রাখে ওরা। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই একজন-সাকিব আল হাসানের নাম নিল।

একেক জন গড় গড় করে বলে উঠল বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম- মুশফিকুর রহিম, মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার, তামিম ইকবাল। সদ্য নিষিদ্ধ অলরাউন্ডার সাকিব সম্পর্কে ভালোই তথ্য জানা আছে ইন্দোরের এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের।

প্রীতি ম্যাচ শেষে এক ফ্রেমে বন্দী বাংলাদেশ-ভারতের সাংবাদিকরা, ছবি: রতন গোমেজ, বিসিবি

একজন মনে করিয়ে দিল, বিশ্বকাপে তো দারুণ খেলেছে তোমাদের সাকিব। ক্লাস সেভেনের ছাত্র মনীষ বিক্রম বলছিল, 'ও বেশ ভালো একজন অলরাউন্ডার। বিশ্বকাপে দারুণ খেলেছে। আর আইপিএলেও ও ভালো খেলেছে।'

শুধু খেলাধুলাই নয়, নানা বৈচিত্র্যের নিজেদের দেশটা নিয়েও এমেরাল্ড হাইটস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থীদের গর্বের শেষ নেই। চশমা চোখে ছোট্ট রনবীর বলছিল, 'আমি আমার দেশকে খুব ভালোবাসি, এখানে অনেক ধর্ম আর অনেক ভাষার মানুষ রয়েছে। আর উৎসবের শেষ নেই। আমাদের দেশটা অনেক বড়। জনসংখ্যায়ও আমরা বিশ্বের দ্বিতীয়। আমাদের শিল্প সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। দিওয়ালি আর হোলিতে অনেক আনন্দ করি আমরা।'

স্কুলের ছোট্ট এই শিশুদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন মাঠের ক্রিকেট প্রায় শেষ। ভারতের ক্রীড়া সাংবাদিকদের একশ ছাড়ানো সংগ্রহটা টপকে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। ইয়াসিন রাব্বি ব্যাট হাতে ঝড় তুললেও লক্ষ্যটা ঠিক পূরণ হয়নি। তবে শেষ ওভার পর্যন্ত লড়াইয়ের উত্তেজনাটা রাখলেন-ইসাম, বর্ষণ কবির, সামি, সাকিব, সবুজ, অনন্ত, বাপ্পা, শোয়েব, একুশ, সাদি ও সাইফুলরা!

দ্য এমেরাল্ড হাইটস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকে সেলফিতে বন্দী

আমার তখন বিদায় নেওয়ার পালা। সেলফিতে ওদের সঙ্গে সময়টা ধরে রেখে যখন উঠতে যাবো তখনই এমন চমক অপেক্ষা করছে কে জানতো। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যাদের সঙ্গে প্রায় ঘন্টা খানেক কথা বলে কতোকিছু জানলাম-তাদেরই একজন এসে পা ছুঁইয়ে আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বসল। কোনোভাবেই তাকে আটকাতে পারলাম না। এরপর দেখি বাকীরাও কী ভেবে যেন একইভাবে বিদায় জানাল আমাকে!

কী বলবো, কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিব্রত আমি, ওরা বুঝতে পারছিল নিশ্চয়ই। ওদেরই একজন কাছে এসে স্পষ্ট ইংরেজিতে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, 'আমরা যদি গুরুজনকেই শ্রদ্ধা জানাতে না পারি, তাহলে বড় হবো কিভাবে?'

এরপর আর কথা থাকে না। এটাও আর জানার প্রয়োজন পড়ে না এমেরাল্ড হাইটস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উচ্চতায় কেন সবাইকে ছাড়িয়ে? অন্যরকম মুগ্ধতা সঙ্গী করেই ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের এক স্বর্গ থেকে ফিরলাম!

কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গেলাম, ফের একটিবারের মতো ফিরে আসতে চাই এই শহরে.. এই স্বর্গোদ্যানে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর