মুশফিকের হাফ সেঞ্চুরিতে তিন দিনে গেল পিঙ্ক টেস্ট

ক্রিকেট, খেলা

আপন তারিক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, কলকাতা (ভারত) থেকে | 2023-08-30 01:47:39

বিধ্বস্ত, পরিকল্পনাহীন আর দিশেহারা বাংলাদেশের দেখা মিলল ইডেন গার্ডেন্সে। হারটা যেন মাঠে নামার আগেই মেনে নিয়েছিল দল। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। তবে শনিবার দিনের খেলা শেষ হতেই যেন গ্যালারিতেও স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল। যাক, দুই দিনে অন্তত হারতে হলো না!

তবে কলকাতায় সূর্য ডোবার পর বিরাট কোহলির সিদ্ধান্ত বিপাকে ফেলে দেয় টাইগারদের। বল সুইং করছে এটা দেখে তখনই ইনিংস ঘোষণা করে ফেললেন ভারত অধিনায়ক। ১ম ইনিংসে সংগ্রহ ৯ উইকেটে ৩৪৭। ইডেনের মিডিয়া বক্সে পাশেই বসা ভারতের এক সাংবাদিক হাসি মুখে বলে উঠলেন. 'ম্যাচ আজই শেষ হয়ে যাবে।'

আরেকজন উৎসাহ নিয়ে স্কোরারের কাছে জানতে চাইলেন দিনের ওভার কতো বাকি! ৪৪ ওভার! ব্যস তাদের মুখে যেন স্বস্তির হাসি। তিন দিন নয়, দু'দিনেই টেস্ট শেষের সুবাস যেন পাচ্ছিল স্বাগতিকদের গণমাধ্যম। তবে স্বস্তি এটাই- ম্যাচটা টেনে নেওয়া গেল তৃতীয় দিনে! যার পুরো কৃতিত্বটাই মুশফিকুর রহিমের। অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তুললেন হাফসেঞ্চুরি। তার দৃঢ়তায় উপমহাদেশের প্রথম পিঙ্ক বল টেস্ট ম্যাচটা তিন দিনে গেল।

যদিও এটা নিশ্চিত গোলাপি বলে দিবা-রাত্রির টেস্টে অভিষেকটা মনে রাখার মতোই হতে যাচ্ছে ভারতের। আর উল্টোটা বাংলাদেশের। ইনিংস হার বাঁচাতে এখনো চাই ৮৯ রান। হাতে উইকেট ৪টি।

ইডেনে অনেক আলোচিত এই লড়াইয়ে শুধু টসটাই জিতেছে বাংলাদেশ। এরপর আর কিছুই করা হয়নি। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে দল অলআউট ১০৬ রানে। তারপর ৯ উইকেটে ৩৪৭ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। তারপর শনিবার ২৪১ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে নেমে আরও ভরাডুবি নখদন্তহীন টাইগারদের। দ্বিতীয় ইনিংসে সংগ্রহ ৬ উইকেটে ১৫২ রান।

অবশ্য এমন ভরাডুবি টেস্টে নতুন কিছু নয়। আমরা যদি বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির বছর থেকেই দেখি, তবে দেখব দু'দিনে শেষ ৬টি টেস্ট। সবশেষ এই ভারতই গেল বছর দুই দিনে হারিয়েছিল আফগানিস্তানকে। আর সব মিলিয়ে শতবর্ষের টেস্ট ইতিহাসে দুদিনে ম্যাচ শেষ হয়েছে ২১ বার। ভাগ্য ভালো এই কলঙ্ক লাগল না টাইগারদের গায়ে।

যেখানে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা দাপটের সঙ্গে খেলতে পারেন সেখানে বাংলাদেশকে চেনাই গেল না। বোলাররা যা একটু লড়েছিলেন, কিন্তু ব্যাটসম্যানরা কোয়ালিটি বোলিংয়ের জবাবে এখনো যেন নবিস! আর সেই দলটা ইডেনের মাঠে যা খেলল তার অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ নেই।

অথচ যোগ্যতার পরিধি দেখানোর দারুণ মঞ্চ পেয়েছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। কিন্তু ইডেন যেন হয়ে উঠল সাম্প্রতিক সময়ের টাইগার ক্রিকেটের আয়না। যেখানে দেশের লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটের কঙ্কালটাও বেরিয়ে এসেছে। হয়তো এটাই বাস্তবতা।

টেস্টের দ্বিতীয় দিনে শনিবার প্রথম অংশটা ছিল বিরাট কোহলির। ইডেনে আরেকটি শতরান তুলে নিয়েছেন ভারত অধিনায়ক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই মাঠে খেলা নিজের শেষ ম্যাচটাতেও দু'হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান।

দিনটা শুরু হয়েছে ৫৯ রান নিয়ে। তারপর নন্দন কাননে নিজের সেই সহজাত ব্যাটিংটাই দেখালেন বিরাট। স্পিনার তাইজুল ইসলামের বলে স্কোয়ার লেগে পাঠিয়ে দুই রান নিয়ে টেস্টে নিজের ২৭তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি। তিন অঙ্কে পৌঁছতে খেলেন ১৫৯ বল। অধিনায়ক হিসেবে এটি বিরাটের ২০তম সেঞ্চুরি।

আর এটা তো মনে রাখতেই হবে গোলাপি বলে ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান বিরাট! শতরান করে অবশ্য বেশিক্ষণ টিকে থাকেন নি তিনি। এবাদত হোসেনের বলে ডিপ স্কোয়ার লেগে তাইজুল ইসলামের অবিশ্বাস্য ক্যাচে আউট অধিনায়ক। তার আগে করলেন ১৯৪ বলে ১৩৬।

বিরাট ছাড়াও লড়লেন আজিঙ্কা রাহানে ও চেতেশ্বর পূজারা। দুজনের ব্যাট থেকেই আসে হাফসেঞ্চুরি। দ্বিতীয় দিনে আবু জায়েদ রাহি ও আল-আমিন দারুণ সুইং পেলেন। এ কারণেই কীনা কে জানে অলআউট হওয়ার আগেই ইনিংসটা ঘোষণা করে দেন বিরাট!

তারপর বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে নেমে যা করে দেখাল তা এক কথায় হতাশাজনক। ইনিংস হার এড়ানোর লড়াইয়ে নেমে প্রথম ওভারেই শূন্য রানে সাজঘরে সাদমান ইসলাম।ইশান্ত শর্মার সুইং বলটা খেলতে পারলেন না, বল এসে লাগল প্যাডে। এলবিডব্লিউ! রিভিউ নিয়েও লাভ হলো না!

তারপর মুমিনুল হকও সেই একই পথের পথিক। প্রথম ইনিংসের মতো এবার কোনো রান না করেই অধিনায়ক ধরলেন সাজঘরের পথ। জোড়া শূন্য, মানে ‘পেয়ার।’ ইতিহাসে ২৩তম বার ক্যাপ্টেন পেলেন পেয়ার!

তিনিও ইশান্তের শিকার। অফ স্টাম্পের বাইরে পিচ করে যে বলটা বেরিয়ে যাচ্ছিল তাতেই কীনা জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট চালালেন। বল তার ব্যাটে লেগে আশ্রয় নেয় উইকেট কিপারের গ্লাভসে।

তারপর মোহাম্মদ মিঠুন ও ইমরুল কায়েসও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গড়তে পারলেন না প্রতিরোধ। ইশান্তের বল মাথায় লেগে এমনিতেই অস্বস্তিতে ছিলেন মিঠুন। চা বিরতির পর উমেশ যাদবের বলে মোহাম্মদ শামির হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। করেন মাত্র ৬। গোটা সিরিজটাই হতাশার কাটল তার। ইন্দোরে টেস্টে দুই ইনিংসে তুলেছিলেন মাত্র ১৩ ও ১৮!

কিছুই করতে পারেননি ইমরুল কায়েসও। এবারও তাকে সাজঘরের পথ দেখালেন সেই ইশান্ত। তার সুইং বলে ব্যাট পেতে দিয়েই বোকা বনে গেলেন। দলের যখন ১৩ তখনই শেষ ৪ উইকেট! ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়!

তখনই জুটি বাঁধলেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের ব্যাটে কিছুটা প্রতিরোধ অন্তত গড়ে তুলে বাংলাদেশ। জুটি যখন জমে উঠল তখনই সর্বনাশ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ ছাড়েন মাহমুদউল্লাহ। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোটে কাবু রিয়াদ। অবসর নিয়ে মাঠে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ৪১ বলে ৩৯ রান।

এরপর মুশফিকের সঙ্গে যোগ দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। শুরুতে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বল স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু আজিঙ্কা রাহানে মিস করলে ৪ রানের সময় প্রাণে বাঁচেন মিরাজ। শেষ অব্দি তিনি ফিরেন ১৫ রানে। তবে মুশফিক ছিলেন অবিচল। দিন শেষে ৫৯ রানে অপরাজিত সাবেক এই অধিনায়ক।

ম্যাচটা তৃতীয় দিনে গেলেও সবচেয়ে দুঃখ হচ্ছে ইডেনের দর্শকদের জন্য। যারা গোলাপি বলের টেস্ট দেখার জন্য অধীর হয়ে ছিলেন। প্রথম দিনই শুক্রবার উত্তাল হয়ে উঠেছিল গ্যালারি। শনিবারও একই দৃশ্যপট। মাঠ ভর্তি দর্শক। গগন বিদারী চিৎকার, মেক্সিকান ওয়েভ! টেস্টের প্রথম চার দিনের টিকিটই বিক্রির খবরটাও ভাসছিল বাতাসে। টি-টোয়েন্টির এই যুগে টেস্ট ম্যাচকে ঘিরে এমন রোমাঞ্চে জল ঢেলে দিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।

রোববার ছুটির দিনে চটজলদিই হয়তো গোলাপি টেস্ট জয়ের আনন্দে মাতবে ভারত!

সংক্ষিপ্ত স্কোর-

বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ১০৬/১০ (৩০.৩ ওভারে, সাদমান ২৯, ইমরুল ৪, মুমিনুল ০, মিঠুন ০, মুশফিক ০, মাহমুদউল্লাহ ৬, লিটন দাস ২৪ রিটায়ার্ড হার্ট, নাঈম হাসান ১৯, এবাদত ১, মেহেদি ৮, আল আমিন ১, আবু জায়েদ ০, অতিরিক্ত ১৪; ইশান্ত ৫/২২, উমেশ ৩/২৯ ও শামি ২/৫)।

ভারত প্রথম ইনিংস: ৮৯.৪ ওভারে ৩৪৭/৯ (ডি.) (আগের দিন ১৭৪/৩) (মায়াঙ্ক ১৪, রোহিত ২১, পূজারা ৫৫, কোহলি ১৩৬, রাহানে ৫১, জাদেজা ১২, ঋদ্ধিমান ১৭*, অশ্বিন ৯, উমেশ ০, ইশান্ত ০, শামি ১০*; আল-আমিন ৩/৮৫, আবু জায়েদ ২/৭৭, ইবাদত ৩/৯১ ও তাইজুল ১/৮০)।

বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: ১৫২/৬, ৩২.২ ওভার (সাদমান ০, ইমরুল ৫, মুমিনুল ০, মিঠুন ৬, মুশফিক ৫৯ ব্যাটিং, মাহমুদউল্লাহ ৩৯ রিটায়ার্ড হার্ট, মিরাজ ১৫ ও তাইজুল ১১; ইশান্ত ৪/৩৯ ও উমেশ ২/৪০)।

*দ্বিতীয় দিন শেষে

এ সম্পর্কিত আরও খবর