বিসিবি যেন এখন ‘জ্ঞান’ বিতরণ কেন্দ্র!

ক্রিকেট, খেলা

স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 05:45:03

ব্যাপারটা যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিটি ম্যাচ বা সিরিজ শেষ হচ্ছে আর তার ময়নাতদন্ত করছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। চলছে কাটাছেঁড়া। প্রকাশ্যে দলের এবং ম্যানেজমেন্টের সমালোচনা করছেন। জানিয়ে দিচ্ছেন অধিনায়কের কোন কোন সিদ্ধান্ত তার পছন্দ হয়নি। গলা ফাটাচ্ছেন- কোচ কেন ব্যাটিং অর্ডারে অমন বদল এনেছেন। ম্যাচের অমুক সময়ে তমুককে বল করতে না দিয়ে অধিনায়ক কি বিশাল ভুল করেছেন!

আর পাকিস্তানের মাটিতে টি-টোয়েন্টি হেরে আসা দলের খেলা দেখে তিনি বলেই বসলেন- ‘এটা যে বাংলাদেশ দল, সেটা নাকি তার মনেই হয়নি!’

অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এত দেরিতে কেন ব্যাট করতে নামেন- সেটা জানিয়ে তিনি যা বলছেন- ‘ওকে দেখে মনে হয়েছে পারলে সে যেন সবার পরে নামে’!

বোর্ড সভাপতির এই কথার ব্যাখ্যা তাহলে কি দাঁড়াল?

-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উপরের দিকে ব্যাট করতে ভয় পান!

-প্রতিপক্ষের বোলারদের এড়াতে পালিয়ে থাকেন!

বোর্ড সভাপতি আরো অনেক প্রশ্ন তুলছেন- লিটন কেন ব্যাটিং অর্ডারে এত দেরিতে। মেহেদি হাসান কেন আগে? টসে জিতে আগে কেন ব্যাটিং? স্কোরবোর্ডে এত কম রান কেন?

বিসিবি সভাপতি জাতীয় দল নিয়ে প্রতিদিনই যে এমন প্রশ্ন তুলছেন তা দেখে মনে হচ্ছে এমন প্রশ্ন তুলে নিয়মিত ভঙ্গিতে জাতীয় দলকে চিড়ে চ্যাপ্টা করাই বোধকরি তার একমাত্র কাজ!

অথচ বিসিবি সভাপতি হিসেবে শুধু জাতীয় দলের মধ্যেই তার চিন্তা আটকে থাকার কথা নয়। তার চিন্তার দিগন্ত তো আরো প্রসারিত করা প্রয়োজন। শুধু জাতীয় দল নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট কিভাবে চলবে- সেই দিকদর্শন নিরূপণের কঠিন দায়িত্বও তারই। বিসিবির শীর্ষ কর্তাদের আমরা কেবল জাতীয় দল নিয়েই চর্চা করতে দেখছি। কই তারা তো কেউ কখনো রাজশাহীর ক্রিকেট, চট্টগ্রামের ক্রিকেট বা যশোরের ক্রিকেট নিয়ে স্বস্তিদায়ক কোনো পরিকল্পনা কি কখনো দিয়েছেন?

২০১২ সাল থেকে আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার জন্মকাহিনী শুনিয়ে আসছে বিসিবি। কিন্তু সেই সংস্থার কাঠামোই আজ পর্যন্ত নির্মাণ হলো না। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হচ্ছে, কিন্তু সেটা নেহাতই দায়সারা গোছের।

উদাহরণ চান?

৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া জাতীয় ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) দিকেই তাকান। আগে এই প্রতিযোগিতা হতো ডাবল লিগ পদ্ধতিতে। এবার হচ্ছে সিঙ্গেল লিগ। অর্থাৎ মাত্র তিন রাউন্ডেই শেষ একটি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট লিগ! মাঠের অভাবের কারণেই এবারের বিসিএল সিঙ্গেল লিগ পদ্ধতিতে হচ্ছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় স্টেডিয়াম আছে অথচ বিসিবি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট আয়োজনের জন্য মাঠ পাচ্ছে না।

এবারের বিসিএলের দুটি দলই বিসিবি’র। লিগের সবগুলো দল স্পন্সর না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে বিসিবিই নিজের টাকায় বিসিএলের দলের পরিচালনায়। বিপিএলেও দলগুলোর মালিক ছিল বিসিবি। এবার বিসিএলেও একই চর্চা বহাল।  

প্রতিটি ম্যাচের শেষে জাতীয় দলের ছিদ্র না খুঁজে বিসিবির শীর্ষ কর্তাদের উচিত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের যথাযথ পরিচর্যার দিকে আরো বেশিমাত্রায় মনোযোগী হওয়া।

মাঠ খোঁজা। সেটা খেলার উপযোগী রাখা। যথাযথ উইকেট তৈরি করা। দলগুলোর জন্য স্পন্সর খোঁজা। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে আরো প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে তোলা।

বিসিবি’র শীর্ষ পর্যায় থেকে কোচ-অধিনায়ক এবং নির্বাচকদের নিয়ে হরদম এমন সমালোচনা কোনোকিছুরই সমাধান বয়ে আনবে না। প্রতিটি ম্যাচের পরে প্রকাশ্যে কোচ-অধিনায়ক ও নির্বাচকদের এমনভাবে ধুতে থাকলে এরা তো মাঠে যে কোনো ছোটখাট সিদ্ধান্ত নিতেও আতঙ্কে থাকবেন।

বিসিবি ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং মানসিক অবস্থা দৃঢ় করার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচা করে বিদেশি মনোচিকিৎসকদের ডেকে আনছে। কিন্তু সেই বিসিবিই প্রতি ম্যাচের শেষে কোচ-খেলোয়াড়-অধিনায়ক এমনকি নির্বাচকদেরও নেতিয়ে দিচ্ছে! তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিচ্ছে।

সৌরভ গাঙ্গুলি এখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। কই কখনো কি শোনা গেছে সৌরভ কোনো ম্যাচে ভারতের হারের পর বলছেন-কোহলি কেন চারে খেলছে? কেএস রাহুল কেন ওপেন করছে?

সৌরভ বলছেন না। কারণ তিনি জানেন কখন কোথায় কি বলতে হয়। আর তাই ক্রিকেট ছাড়ার পর এখনো সৌরভ ‘সুরভিত’।

আর আমরা প্রতিনিয়তই প্রায় প্রতি ম্যাচ শেষেই ক্রিকেটারদের জ্ঞান বিতরণ করে চলেছি।

জ্ঞান বিতরণ বিষয়ে বিখ্যাত একটা উক্তি মনে পড়ে গেল-‘জ্ঞান হলো অন্তর্বাসের মতো। পরার প্রয়োজন আছে, দেখানোর প্রয়োজন নেই!’

এ সম্পর্কিত আরও খবর